- হাসান আল মাহমুদ
১৬ জুলাই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ইয়েমেনে বন্দি ভারতীয় নার্স নিমিশা প্রিয়ার ফাঁসি স্থগিত করা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এর নেপথ্যে যে এক হৃদয়স্পর্শী মানবিক প্রচেষ্টা ছিল, তা উঠে এসেছে ভারতের গ্র্যান্ড মুফতি কাঁথাপুরম এপি আবুবকর মুসলিয়ার ভূমিকায়।
মুফতি আবুবকর মুসলিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি ইয়েমেনের হুথি নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা অবস্থায় ভারতের গ্র্যান্ড মুফতি আবুবকর মুসলিয়া নিজ উদ্যোগে বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি ইয়েমেনের প্রভাবশালী ইসলামি স্কলারদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। পরে সেই আলেমরা ইয়েমেনি প্রশাসনের কাছে প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড স্থগিতের বিষয়ে অনুরোধ জানান এবং আলোচনায় বসেন।
আলেমদের এক প্রতিনিধি ও নিহত ইয়েমেনি নাগরিক তালাল মাহাদির পরিবারের একজন সদস্যের মধ্যে সরাসরি কথা হয়। ইসলামিক শরিয়াহ অনুযায়ী ‘দিয়াত’ বা রক্তমূল্য গ্রহণের সম্ভাবনা আলোচনায় আসে।
ইসলামী শরিয়াহ ও রক্তমূল্য
গ্র্যান্ড মুফতি আবুবকর মুসলিয়া বলেন, ‘ইসলামে হত্যার পরিবর্তে ‘দিয়াত’ বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। আমি নিহতের পরিবারকে এই পথে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি।’
ভারতের পক্ষ থেকেও নিহতের পরিবারকে প্রায় আট কোটি ৬০ লাখ টাকা (রক্তমূল্য) দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে তারা মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করতে রাজি হয়, যদিও এখনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি।
ভারত সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইনি প্রতিনিধিরা ইয়েমেনের প্রসিকিউটর ও কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। সেই ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলেই প্রিয়ার মৃত্যুদণ্ড এই মুহূর্তে স্থগিত করা সম্ভব হয়েছে।
নিমিশা প্রিয়ার মামলা সংক্ষেপে
- ২০০৮ সালে কেরালার নার্স নিমিশা ইয়েমেনে যান।
- স্থানীয় ব্যবসায়ী তালাল মাহাদি-এর সঙ্গে যৌথভাবে ক্লিনিক চালাতেন, যিনি পরবর্তীতে তাকে হয়রানি করেন ও পাসপোর্ট আটকে রাখেন।
- ২০১৭ সালে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে গিয়ে তালালকে ঘুমের ওষুধ পুশ করেন। এতে তার মৃত্যু হয় এবং নিমিশা গ্রেফতার হন।
- ২০২০ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ আদালতে বহাল থাকে।
বর্তমান অবস্থা
নিমিশা এখনো সানার একটি হুথি-নিয়ন্ত্রিত কারাগারে বন্দি। মৃত্যুদণ্ড স্থগিত হলেও মুক্তি বা ভারতে ফেরার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আপাতত রক্তমূল্যের আলোচনাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র পথ।
এদিকে এমন উদ্যোগে প্রশংসায় ভাসছেন ভারতীয় গ্র্যান্ড মুফতি কাঁথাপুরম এপি আবুবকর মুসলিয়া। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পুরো প্রক্রিয়ায় ভারতের সরকার, মানবাধিকার সংগঠন এবং বিশেষ করে গ্র্যান্ড মুফতি আবুবকর মুসলিয়ার মানবিক হস্তক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে গড়ে ওঠা এই উদ্যোগ শুধু একজন নার্সের প্রাণ বাঁচানোরই চেষ্টা নয়, বরং আন্তধর্মীয় সহানুভূতি ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকলো।
কে এই ভারতের গ্র্যান্ড মুফতি কাঁথাপুরম এপি আবুবকর মুসলিয়া?
১৯৩১ সালের ২২ মার্চ কেরালার কোঝিকোড় জেলার কাঁথাপুরমে জন্মগ্রহণ করা এই আলেম বর্তমানে ভারতের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদ, ‘গ্র্যান্ড মুফতি’-র দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অল ইন্ডিয়া তানজিম উলামায়ে ইসলাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করা মুহাম্মদ আখতার রাজা খান ছিলেন এই পদে।
গ্র্যান্ড মুফতি মুসলিয়ার শান্তি, সহনশীলতা ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের পক্ষে বরাবরই সোচ্চার। তিনি দুবাইয়ের শেখ জায়েদ আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের চেয়ারম্যান, পাশাপাশি পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন ‘মানব ভ্রাতৃত্ব সম্মেলনে’। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থানও দৃঢ়; আইএসের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে তিনি প্রথম আলেম হিসেবে আন্তর্জাতিক মনোযোগ পান।
মুসলিয়ার ‘মারকাজ নলেজ সিটি’ এবং ‘মারকাজ ইউনানি মেডিকেল কলেজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষায় অবদান রেখেছেন। তার মতে, “শিক্ষা হলো শান্তির চাবিকাঠি।’
২০২৩ সালে মালয়েশিয়ায় তিনি “টোকোহ মাল হিজরাহ আন্তর্জাতিক পুরস্কার” লাভ করেন। এছাড়া, ইসলামিক হেরিটেজ পুরস্কার, রত্নপাথর বিজ অ্যাওয়ার্ড, এবং ২০০৯-২০২০ সাল পর্যন্ত জর্ডানের রয়্যাল ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার প্রকাশিত বিশ্বের ৫০০ প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় তার নাম স্থান পায়।