চিকিৎসকদের জন্য চ্যালেঞ্জের ২০২০

কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরুতে চিকিৎসাসেবা নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীর চিকিৎসা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন চিকিৎসক সমাজ। তারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ২০২০ সাল ছিল চিকিৎসকদের জন্য চ্যালেঞ্জের। এ চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বহু চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত ও প্রাণ হারিয়েছেন।

চিকিৎসক নেতারা জানান, দেশে করোনার সংক্রমণের শুরুতে কোভিড এবং নন-কোভিড চিকিৎসা দেওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন চিকিৎসকরা। সংক্রমণের প্রথমদিকে ঝুঁকি ছিল। পরবর্তী সুরক্ষাসামগ্রী সংকট দূর হওয়ায় ঝুঁকি কমে আসে। কমে আসে ভীতিও। করোনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশের চিকিৎসকরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

স¦াস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ৮ মার্চ প্রথম ৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৫১০ জন। এর মধ্যে চিকিৎসক আছেন ৩ হাজার ৩০০ এবং নার্স ২ হাজার ৫৬০ জন। দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৭ হাজার ৫৫৯ জন। এর মধ্যে চিকিৎসক ১৩০ এবং নার্স ১৮ জন। এ ছাড়া টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ডবয়সহ অনেক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত ও মারা গেছেন।

করোনা সংক্রমণের শুরুতে ঢাকার দুটি হাসপাতাল- কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত ছিল। পরীক্ষাগার নির্ধারণ করা হয় আইইডিসিআর। করোনা সংক্রমণ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে থাকায় পরীক্ষাগার ও চিকিৎসা কেন্দ্রে বাড়াতে থাকে সরকার। বর্তমানে সারা দেশের ১৮০টি পরীক্ষাগারে করোনা পরীক্ষা এবং ২৩টি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।

করোনা সংক্রমণের প্রথমদিকে মাস্ক, পিপিই সংকট থাকায় এবং নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী দেওয়ার কারণে অনেক চিকিৎসক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা দিতে অনাগ্রহ দেখান। পরবর্তী সময়ে সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ বাড়তে থাকলে চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে সংক্রমণের ভয়ে প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ হয়ে যায়। অনেক বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ রোগীর চিকিৎসা নিয়ে ভোগান্তি তৈরি হয়। তবে এ সংকট ধীরে ধীরে কেটে যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেছেন, চীনে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার প্রায় ২ মাস পর আমাদের দেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে।

এ সময় দেশের ফ্রন্টলাইন ফাইটার্সদের (চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী) প্রস্তুত করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। এ ছাড়া সুরক্ষাসামগ্রীর অপ্রতুলতা ছিল। প্রথমদিকে পরীক্ষা কেন্দ্র বৃদ্ধি নিয়েও সমস্যা ছিল। পরবর্তী সময়ে অনেক পরীক্ষা কেন্দ্র হয়েছে। চেইন অব কমান্ড সমস্যা ছিল। মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মধ্যে টানাপড়েন, ভুল সিদ্ধান্ত ও সমন্বয়হীনতা ছিল। এসব কারণে প্রথমদিকে চিকিৎসাসেবা প্রদানে কিছুটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে এটি চিকিৎসকের কারণে হয়নি। চিকিৎসকদের দায়িত্ব হচ্ছে সেবা প্রদান। তারা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও সে দায়িত্ব পালন করেছেন।

অধ্যাপক কামরুল হাসান খান বলেছেন, দেশের চিকিৎসকদের সঠিকভাবে সাপোর্ট এবং তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিতে পারলে চিকিৎসকরা অবশ্যই ভালো করবেন। যারা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে মহামারীর সময়ে চিকিৎসকরা যেন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে বিষয়টি দেখভাল করা। সে বিষয়ে তাদের সাপোর্ট ও উৎসাহ দেওয়া এবং চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু তারা হেঁটেছে উল্টো পথে। করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রথমদিকে চিকিৎসকদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কাজে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মনে হতাশার জন্ম দেয়। তার পরও আমাদের চিকিৎসকরা তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকে সংক্রমিত হয়েছেন, হারিয়েছেন প্রাণ।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে সারা পৃথিবীই রোগটি নিয়ে অস্থির ছিল। দেশে করোনা আক্রান্তের পরও সরকার, জনগণ, গণমাধ্যম, চিকিৎসকসহ সবাই অস্থির ছিল। এ রোগ ও রোগের সাইন-সিনড্রোমের সঙ্গে কেউ পরিচিত ছিল না। চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও কোনো ধারণা ছিল না। তাই সবার মাঝে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। চিকিৎসকদের যে সুরক্ষাসামগ্রীর স্বল্পতা ছিল, প্রশিক্ষণের স্বল্পতা ছিল, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে চিকিৎসকরা করোনা চিকিৎসার বিষয়ে জানতে পারলেন, সরকার হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হলো, চিকিৎসকদের সুরক্ষাসামগ্রী আসতে শুরু করল তখন সবার মাঝ থেকে ভীতি কেটে গেছে।

দেশের চিকিৎসকরা বর্তমানে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত, আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি জানা, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি অনেক আছে। প্রথম দিকে অনেক চিকিৎসককে হারিয়েছি। এতে কিছুটা মন খারাপ আছে। আরেকটি বিষয় হলো, প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্রের কারণে এখন পর্যন্ত যে ৫৪ জন প্রণোদনা পেয়েছেন তাদের মধ্যে চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। এ আমাদের হতাশা কাজ করছে। আমাদের প্রায় ৩ হাজার ৩০০ চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১৩০ চিকিৎসক মারা গেছেন। এত ঝুঁকির মধ্যে চিকিৎসকরা সেবা দিয়ে গেছেন।

ডা. ইহতেশামুলক হক চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী করোনা ইউনিটে যারা ডিউটি করবেন তারা ডিউটি শেষে বাসায় না গিয়ে হোটেলে বা অন্য কোনো স্থানে আইসোলেশনে থাকবেন। কিন্তু এই নিয়ম পালন করা হয়নি। এতে একটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ চিকিৎসকরা করোনা ইউনিটে ডিউটির পর বাসায় গেলে পরিবার সংক্রমিত হতে পারে এমন শঙ্কায় তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করেছে।

ডা. ইহতেশামুলক হক চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবারই সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন দেশে করোনায় মৃত্যু কম হয়েছে। যদি মৃত্যু কম হয় তা হলে এর ক্রেডিট চিকিৎসকদের, স্বাস্থ্যকর্মীদের।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির আমাদের সময়কে বলেন, চিকিৎসকরা হচ্ছেন ফ্রন্টফাইটার। করোনাকালে অনেক মানুষ তার পরিবারের অসুস্থ সদস্যকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নিয়ে যাননি, এমনকি সন্তান তার বাবার লাশ দাফন করতে যাননি। এত প্রতিকূল পরিবেশে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালে গিয়েছেন, চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এত ঝুঁকির মধ্যে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে কাজ করেছেন, এখনো করছেন।

অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির বলেন, প্রথমদিকে ঝুঁকি বেশি ছিল, পরবর্তী সুরক্ষাসামগ্রী সরবরাহ বাড়তে থাকায় এই ঝুঁকি কমে এসেছে। এখন করোনার সংক্রমণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিয়ে এ ধারণা মানুষের চলে এসেছে। এতে ভীতি কাটছে।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আল্লামা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী (হুজুর)-এর ইন্তেকালে ইসলামী ঐক্যজোটের গভীর শোক প্রকাশ

নূর নিউজ

চীন থেকে আরও ২০ লাখ টিকা আসছে

আনসারুল হক

শেখ হাসিনা নির্বাচনে হেরে গেলে দীর্ঘ সংকটে পড়বে বাংলাদেশ

নূর নিউজ