দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়ার সৌদি আরব পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, যেকোনও এক দেশের ওপর আগ্রাসন মানে উভয় দেশের বিরুদ্ধে হামলা হিসেবে গণ্য হবে।
চুক্তি নিয়ে সৌদি গণমাধ্যম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে এবং এটিকে ‘ন্যাটোর মতো প্রতিরোধমূলক ছাতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তুর্কি সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড জানাচ্ছে, সৌদি আরবের সংবাদমাধ্যমগুলো রিয়াদ ও ইসলামাবাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তিকে ‘প্রতিরোধমূলক ছাতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যা উভয় দেশকে সীমাহীন সামরিক সক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেবে।
গত বুধবার রিয়াদে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সৌদি প্রেস এজেন্সি (এসপিএ) প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “চুক্তির লক্ষ্য হলো নিরাপত্তা জোরদার করা, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং যেকোনও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলা।” চুক্তিতে বলা হয়েছে, “যেকোনও এক দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন মানে উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন।”
একজন জ্যেষ্ঠ সৌদি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এটি বহু বছরের আলোচনার ফল। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়, বরং দীর্ঘদিনের গভীর সহযোগিতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। তিনি আরও বলেন, “এটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা চুক্তি, যা সব ধরনের সামরিক সক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত করছে।”
সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান লিখেছেন, “সৌদি আরব ও পাকিস্তান যেকোনও আগ্রাসীর বিরুদ্ধে এক ফ্রন্ট গড়ে তুলবে… সবসময় এবং চিরকাল।” সৌদি দৈনিক ওকাজ লিখেছে, “ক্রাউন প্রিন্স ও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন।” এ উপলক্ষে সৌদি শহরগুলোর টাওয়ারগুলোতে উভয় দেশের পতাকা আলোকিত করা হয়।
সৌদি পত্রিকায় কলাম লেখক মুতেব আল আউয়াদ চুক্তিটিকে ‘ইসলামি ফ্রন্টের ঐতিহাসিক দুর্গ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার মতে, সৌদি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রতিরোধশক্তি যুক্ত হয়ে আঞ্চলিক প্রতিরোধকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তিনি লিখেছেন, সৌদি আরবের অর্থনৈতিক শক্তি, উন্নত সামরিক সক্ষমতা এবং ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোর অভিভাবকত্ব তাকে আঞ্চলিক নেতৃত্ব দিয়েছে।
পাকিস্তানও পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে, বিশাল সেনাবাহিনী, ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার এবং আরব সাগরের তীরে শক্ত অবস্থানের কারণে যৌথ প্রতিরক্ষা কাঠামোকে শক্তিশালী করেছে। চুক্তি কার্যত ‘দ্বিপক্ষীয় যৌথ নিরাপত্তা ছাতা’ তৈরি করেছে, যাতে থাকবে যৌথ অভিযান পরিকল্পনা, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি, সামরিক মহড়া, নৌ ও বিমান সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুনীফ আম্মাশ আল-হারবি বলেছেন, চুক্তি উভয় দেশকে সীমাহীন সামরিক সক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিয়েছে এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পক্ষগুলোকে শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। সৌদি বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফয়সাল আল-হামাদ বলেছেন, “চুক্তিটি ন্যাটোর নীতি অনুসরণ করেছে। এক দেশের ওপর আক্রমণ মানেই উভয় দেশের ওপর আক্রমণ।”
পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলোও এই চুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। সৌদি প্রেস এজেন্সি জানায়, চুক্তির পর ইসলামাবাদের আকাশচুম্বী ভবনগুলো উভয় দেশের পতাকায় আলোকিত করা হয়েছিল। সৌদি দৈনিক আল-রিয়াদ লিখেছে, “ক্রাউন প্রিন্স পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।” আল-মাদিনা শিরোনাম দিয়েছে, “সৌদি ও পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি।”
চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো কাতারের রাজধানী দোহায়, ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার মাত্র এক সপ্তাহ পর। সে ঘটনায় পাঁচজন হামাস শান্তি-আলোচক ও একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন। তখন কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তির মধ্যস্থতা করছিল।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড