মিডিয়া ট্রায়াল বা গণমাধ্যমীয় বিচারের ভয়াবহতা

পুলিশ কনস্টেবল (বরখাস্ত) নাজমুল তারেক জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সপরিবারে দাঁড়িয়েছেন। ফেরত চেয়েছেন চাকুরি এবং টিপ-টিজিংয়ের ঘটনায় অভিযোগকারী লতা সমাদ্দার ও তদন্ত কর্মকর্তার বিচার চেয়েছেন। তার দাবি, মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। সেখানে একজন বড়মাপের সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্বরত অবস্থায় রাস্তায় নারীকে অশ্লীল কথা বলেছেন। এটা কোন ছোটখাটো অপরাধ নয়। তার পেশার চরিত্র চিন্তা করলে এই লোককে চাকরিতে রাখা বিপজ্জনক। এই ছবিতেও সে কতটা নারী বিদ্বেষী তার প্রমাণ আছে, সে লতা সমাদ্দারের বিচার চায়। চাকরি তো ফেরত দেয়ার প্রশ্নই আসে না, তাকে গ্রেফতার করা উচিৎ। ভয়ংকর জঙ্গি মানসিকতার লোক সে। সে অনুতপ্ত নয়, তদন্ত কর্মকর্তার বিচার চায়! কতবড় আস্পর্ধা!’

উল্লেখিত স্ট্যাটাসসহ এ জাতীয় শতাধিক স্ট্যাটাস দেখে আমার বিশ্বাস আরও গভীর হয়েছে যে, নাজমুল তারেক মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার। অথচ এই কথাটি সেভাবে বলা হচ্ছে না। বেশ কয়েক বছর ধরেই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে স্পর্শকাতর ধর্মীয় ইস্যুতে অনেককেই মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হতে দেখছি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এভাবে গণমাধ্যমের বিচার কোন আইনে সিদ্ধ, সেটা জানা দরকার।

মিডিয়া ট্রায়াল কী?

খুব সহজ কথায়, কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা এবং আদালতে বিচারিক রায় ঘোষণার আগেই সামাজিক মাধ্যমে জনসাধারণ তার বিরুদ্ধে একধরনের রায় দিয়ে ফেলেন। দেশের আইন-আদালত যখন একজন অভিযুক্তকে নিরপরাধ বলছেন, তখন আমাদের দেশের মিডিয়া অভিযুক্তকে বিচার করে নায়ক বা খলনায়ক বানিয়ে সমাজে প্রচার করছে। মিডিয়ার এমন সংস্কৃতিকে ইংরেজিতে মিডিয়া ট্রায়াল বলে। সোজা বাংলায় এটাকে ‘গণমাধ্যমীয় বিচার’ বলা যায়।

 

এই বিচার প্রকৃত অর্থে আদালতের বিচার ব্যবস্থার মতো নয়। যখন সংবাদমাধ্যম কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে ক্রমাগত সংবাদ প্রচার করে জনগণের কাছে তাকে দোষী বা গুণী প্রমাণ করতে চায় তখন একে মিডিয়া ট্রায়াল বলে।

 

মিডিয়া ট্রায়াল এখন প্রতিদিনকার ব্যাপার। মিডিয়া ট্রায়াল সবসময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের নয়া রূপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কাউকে দোষী বা নির্দোষী ধরে স্ট্যাটাস দেই। তারপর এটা যদি ভাইরাল হয়, তখন এই ট্রায়ালে একজনের মানহানি ঘটে, তাতে তার অপূরণীয় ক্ষতি হয়।

 

মিডিয়া ট্রায়াল তথ্য সন্ত্রাসবাদের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মিডিয়া ট্রায়াল এখন অন্য যেকোনো ট্রায়ালের চেয়ে ভয়ঙ্কর।

 

যখন কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিযোগের তদন্ত কিংবা আইনগত প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ার আগেই হয়ে যান তিনি আসামি এবং সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেই বিষয়ে রায় দেওয়ার জন্য। সেখানেই ওই ব্যক্তির সামাজিক মৃত্যু ঘটে। কারও ছবি তোলা, কথা কিংবা মিটিং রেকর্ড করার বিষয়ে অনুমতি নেওয়ার সংস্কৃতি নেই, বরং আছে উল্টোটা। সেগুলো মনের মতো করে ফেসবুকে আপলোড দেওয়া, তার সঙ্গে কমেন্ট জুড়ে দিয়ে সবাইকে জানান দেওয়া হয়। লেখা বা মতামতের বাইরে ছবি নিয়ে শুরু হয় মিডিয়া বিচার।

প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আইনি লড়াই শেষে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালে দোষী বা নির্দোষ প্রমাণের বালাই নেই, আপিলের সুযোগ নেই, যা হয়, একবারেই। এই ক্ষতির কোনো পূরণ নেই। মিডিয়া ট্রায়ালে মারা হয় তিলে তিলে। মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার একজন নির্দোষ মানুষকেও আজীবন দোষের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়।

মিডিয়া ট্রায়ালের আওয়াজ যত জনের কানে যায়, পরে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তা ততজনের কাছে পৌঁছে না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের না হয় কোনো মা-বাপ নেই। কিন্তু গণমাধ্যমের তো কিছু ইথিক্স আছে, জবাবদিহিতা আছে, সম্পাদকীয় বিবেচনা আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে তারাও যেন সব ভুলে যায়, মেতে উঠে প্রতিহিংসাপরায়ণতায়। এভাবে চলতে থাকলে গণমাধ্যমের ওপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাবে। এখন যে খুব আস্থা আছে, সেটাও ভাবার কোনো সুযোগ নেই।

আজ হয়ত একজন, কাল অন্যজন মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু কাল বা পরশু যে আমি-আপনি হবো না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং এখনই সমস্বরে মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধের দাবি উত্থাপন করা দরকার।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

রাশিয়ায় বন্ধ হলো বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইট

নূর নিউজ

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে গুজব ছড়ালে কঠোর ব্যবস্থা, পুলিশ

নূর নিউজ

মাওলানা নুরুল ইসলামের ইন্তেকালে আল্লামা মাহমুদুল হাসানের শোক

নূর নিউজ