মূল: ড. আতিয়া আদলান
অনুবাদ: মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
এই মহান মৌসুম—হজ ও ঈদের সময়ে—যদি আমরা এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও গভীর বার্তাগুলো অনুধাবন না করি, তবে এগুলো কেবল আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হবে। মূলত এইসব কর্মগুলোর প্রকৃত অর্থ নিহিত আছে উম্মাহর ঐক্য, মুসলিম পরিচয় এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্যে। আমাদের উচিত এ মৌসুমকে এমনভাবে দেখা, যেন আমরা এর প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি—শিক্ষা পেতে পারি জীবনের জন্য, রাজনীতির জন্য, সমাজের জন্য।
মুসলিম উম্মাহর পরিচয়ের বৈশিষ্ট্য
ইসলামী পরিচয়ের ধারণা বোঝার জন্য অনেক ইসলামিক ও পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ দার্শনিকভাবে এর বিশ্লেষণ করেছেন। মুসলিম পরিচয় কেবল অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস বা আধ্যাত্মিক অবস্থা নয়—এটা বাহ্যিক দৃশ্যেও প্রতিফলিত হয়। একজন মুসলিম ব্যক্তি বা জাতি—তার পোশাক, আচরণ, কৃষ্টি, জীবনাচার—সবকিছুতেই এই পরিচয় দৃশ্যমান হয়।
“সিবগাতুল্লাহ” (আল্লাহর রঙ) কুরআনের এই পরিভাষা শুধু ঈমান নয়, বরং ঈমানের বহিঃপ্রকাশকেও বোঝায়। এটি আমাদের জানায় যে অন্তরের ঈমান বাহ্যিক চিহ্নে রূপ নেবে, ঠিক যেমন হজের প্রতিটি রুকন মুসলিম উম্মাহর ঐতিহ্য ও ইতিহাস বহন করে।
হজ ও ঈদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা পরিচয়
সূরা বাকারা হলো মুসলিম উম্মাহর চেতনার মূল ভিত্তি। এখানে নবী ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর কাহিনি আমাদের শেখায় কীভাবে একটি জাতির আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে—আল্লাহর ঘর নির্মাণ করে, তা ঘিরে জীবনের কেন্দ্র স্থাপন করে, এবং এক মহান ঐতিহ্যের বীজ বপন করে। হজের প্রতিটি রোকন, প্রতিটি আচার, প্রতিটি প্রতীক এই পরিচয়েরই বহিঃপ্রকাশ।
ইসলামী পদ্ধতির প্রতিচ্ছবি হজ
তিনটি মূল রুকন এখানে ইসলামী পদ্ধতির প্রতীক:
কুরবানি বা নসুক: এটি ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের আত্মসমর্পণের কাহিনির জীবন্ত রূপ। তাদের সেই আত্মত্যাগ আমাদের শেখায় আল্লাহর নির্দেশের সামনে বিনা দ্বিধায় মাথা নত করা।আরাফার ময়দানে অবস্থান: এটিকে কেবল দোয়া বা জমায়েত বললে কম বলা হবে। এটি আসলে ‘আল্লাহর নির্ধারিত সীমায় অবস্থান করার’ প্রশিক্ষণ। রাজনীতি থেকে ব্যক্তি জীবন—সবক্ষেত্রে আমাদের যেখানে থামতে বলা হয়েছে, সেখানে থামা।
জামারায় পাথর নিক্ষেপ: এটি কেবল এক প্রতীক নয়, বরং মনের ভিতরের প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস। এটি যুলুম, ফিতনা, ও শয়তানী চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুসলমানের প্রতিক্রিয়া।
উম্মাহর ঐক্য ও শক্তি
তাওয়াফের দৃশ্যটি দেখুন—পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ এক কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরছে, একই দিকে, একই কায়দায়। এই সমান্তরালতা, এই একক দিকই হলো মুসলিম উম্মাহর শক্তির উৎস।
পৃথিবীর প্রতিটি পদার্থের কণাও যেমন একটি কেন্দ্রে ঘোরে, তেমনই একটি জাতিও যদি এক লক্ষ্য, এক দিক, এক বিধানকে কেন্দ্র করে চলে—তবে তার ঐক্য ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত।
হজের এই শিক্ষা আমাদের জানায়: ঐক্য তখনই সম্ভব, যখন সবাই একই কেন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়—আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাহ ও শরিয়াহর নীতিমালায়।
ঈমানী পথ অনুসরণের গুরুত্ব
একবার ভাবুন—হজরত হাজেরা (আ.) যখন পানি খুঁজে দৌড়াচ্ছিলেন, আজও মুসলমানরা কেন এই কাজটি অনুসরণ করেন, যখন তাদের তৃষ্ণা নেই? কারণ আমরা অনুসরণ করি, আমরা পদচিহ্ন অনুসরণে গৌরব বোধ করি।
এটাই আমাদের চিন্তা-পদ্ধতির স্বাতন্ত্র্য, আমাদের পথ আলাদা। আমাদের মানসিক ও নৈতিক স্বাধীনতা—আমরা যে পথ অনুসরণ করি, তা এক নির্ভরযোগ্য ঐতিহ্যে গাঁথা। আমরা নবজাগরণ চাই, কিন্তু নকল নয়। আমরা নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারি, কিন্তু নিজেদের পথ ও মর্মবাণী ত্যাগ করতে পারি না।
আরাফার ময়দানে ‘অবস্থান’ মানে কী?
কেবল একদিন দাঁড়িয়ে থাকা নয়, আরাফার অবস্থান আমাদের শেখায়—জীবনের প্রতিটি পথ, সিদ্ধান্ত, মত, রাজনীতির মোড়—সবই যেন আল্লাহর নির্ধারিত সীমায় থেকে হয়।
মুসলমান হিসাবে আমাদের কর্তব্য—আল্লাহর সীমারেখায় অবস্থান করা। এটা রাজনৈতিক হোক কিংবা সামাজিক, সব ক্ষেত্রেই এই নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাই আমাদের পরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি।
উপসংহার: নবজাগরণের পথে প্রত্যাবর্তন
আমরা যদি হজ ও ঈদের মৌসুমে এই গভীর বার্তাগুলো আত্মস্থ করতে পারি, তাহলে তা আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র—সবক্ষেত্রে একটি নয়া জাগরণ আনতে পারে। এটি হবে এমন এক জাগরণ, যা অতীতের ঐতিহ্যে দৃঢ়, বর্তমানের চ্যালেঞ্জে সচেতন এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় দৃপ্ত।