এনসিপি নেতাদের অবকাশযাপনের সিসিটিভি ফুটেজ ফাঁস, এটি কি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন?

  • অধ্যাপক ফজলুল করিম পাটোয়ারী

বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে নজরদারি ও তথ্যপ্রবাহ যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি বেড়েছে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঘটনাও। সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যমে এনসিপি নেতৃবৃন্দের অবকাশযাপনের (তাদের ভাষায়) সিসিটিভি ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া নিয়ে জল্পনা কল্পনা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই সন্দেহ করছেন যে অবকাশ যাপনের আড়ালে তারা একজন বিশিষ্ট বিদেশীর সাথে বৈঠক করতে সেখানে গিয়েছেন. হয়তোবা দলীয় স্বার্থে দেশের স্বার্থবিরোধী কোন চক্রান্ত হয়ে যেতে পারে. সন্দেহ যাই হোক, এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করা নিয়ে আজকের আলোচনা. অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন-এটি কি শুধুই সংবাদ পরিবেশন, নাকি একজন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার তথা গোপনীয়তার লঙ্ঘন? NCP-র পক্ষ থেকেও এটিকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন বলে অভিযোগ তুলেছেন।

আসুন জেনে নেই বাংলাদেশের সংবিধানে ও বিভিন্ন আইনে নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করেছে? যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে সরাসরি ‘Privacy’ বা ‘গোপনীয়তা’ শব্দটি নেই, তবে নাগরিকদের মৌলিক গোপনীয়তার অধিকার পরোক্ষভাবে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে “ব্যক্তিগত স্বাধীনতা” এবং ৪৩ অনুচ্ছেদে “ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের নিরাপত্তা” দ্বারা কিছুটা নিশ্চিত করেছে। এছাড়াও, সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কিংবা গোপনীয়তা বিষয়ক সরাসরি কোন আইন না থাকলেও পরোক্ষভাবে শুধুমাত্র ১৯(১)ঙ ধারাটি অনুমতি ছাড়া প্রচার বা প্রকাশ নিষিদ্ধ করে:

“ইচ্ছাকৃতভাবে প্রেরক বা গ্রাহকের অনুমতি ব্যতীত, কোনো পণ্য বা সেবা বিপণনের উদ্দেশ্যে, স্পাম উৎপাদন বা বাজারজাত করেন বা করিবার চেষ্টা করেন বা অযাচিত ইলেক্ট্রনিক মেইল প্রেরণ করেন”

বিশ্বের অনেক দেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপিআর (GDPR) অনুযায়ী, ব্যক্তিগত তথ্য বা ভিডিও প্রকাশের আগে স্পষ্ট সম্মতি আবশ্যক। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে “Reasonable Expectation of Privacy” ধারণা প্রচলিত-যেখানে ব্যক্তি কোনো বেসরকারি স্থানে থাকলে তার গোপনীয়তা রক্ষা করা বাধ্যতামূলক। তবে পাবলিক প্লেসে থাকলে অর্থাৎ সরকারী স্থানে থাকলে তার গোপনীয়তা বজায় রাখার কারো কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি রাস্তাঘাটে জাতি-ধর্ম ছেলে-মেয়ে আবাল বৃদ্ধবনিতা যেকারো ছবি, ভিডিও ধারণ করে প্রকাশ করতে পারবেন। কোন অনুমতির প্রয়োজন নেই। অতএব, যদি কোনো নেতা নিজ বাসস্থান, হোটেল বা ব্যক্তিগত রিসোর্টে অবকাশযাপন করে থাকেন, এবং সেই মুহূর্তের ভিডিও ফুটেজ অনুমতি ছাড়া প্রকাশিত হয়, তবে তা সরাসরি গোপনীয়তা লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।

আবার এটাও আমাদের সবার মানতে হবে যে: গোপনীয়তার অধিকার সীমাহীন নয়। যদি কোন ফুটেজে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার বা জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কিছু উঠে আসে, তাহলে ‘জনস্বার্থে প্রকাশ’ যুক্তি দেওয়া যেতে পারে এবং এটা প্রয়োজনীয়। তবে এই ধরনের তথ্য প্রকাশের পূর্বে যথাযথ আইনগত যাচাই এবং নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকা আবশ্যক।

গণমাধ্যম কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের দায়িত্ব হল সত্য প্রকাশ করা, কিন্তু তা যেন অন্যের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন না করে। একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত জীবন, বিশেষ করে যখন তা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ নয়, তখন তা গোপন রাখার অধিকার রাখে। আর তিনি যদি একজন নেতা হন, এমনকি জনপ্রতিনিধি হলেও, তার ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা একটি অপরিহার্য মৌলিক অধিকার। অবকাশযাপনের সময় ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজ যদি ব্যক্তিগত পরিবেশে হয় এবং তার অনুমতি ছাড়া প্রকাশিত হয়, তাহলে তা স্পষ্টতই আইনগত ও নৈতিকভাবে গোপনীয়তার লঙ্ঘন।

রাজনৈতিক মতপার্থক্য বা জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে গোপনীয় ভিডিও ফাঁস করা সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করে, নাগরিক দায়িত্বশীলতা বর্জিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমাদের প্রয়োজন সতর্কতা, বিবেকবোধ, এবং মানবিকতা—যাতে স্বাধীনতা আর দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।

লেখক: আইটি বিশেষজ্ঞ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এ জাতীয় আরো সংবাদ

জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক আব্দুস শহীদের ইন্তেকালে আলনূর কালচারাল সেন্টারের শোক

আনসারুল হক

ভারতে রমজানেও মুসলিম নির্যাতন, ১৫১ আলেমের উদ্বেগ

আনসারুল হক

জুলাই আন্দোলন: এখন শুধুই আবেগ?

আনসারুল হক