হাসান শাওন
ফার্সি শব্দ ‘জিয়াফত’ অর্থ ভোজ বা ভোজসভা। গ্রাম থেকে শহর—বাংলার নানা অঞ্চলে বহু প্রাচীন কাল থেকে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, সুন্নতে খতনা ইত্যাদি উপলক্ষে জিয়াফত আয়োজনের প্রচলন রয়েছে। এর অন্যতম প্রধান উপাদান হলো গরুর মাংস। গরু কেনা থেকে শুরু করে রান্নায় বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়।
তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলায় দীর্ঘ সময় গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ বা বিরল ছিল। কারণ, উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারগণ গরুর মাংস পছন্দ করতেন না। তাই গরু জবাই এবং খাওয়া নিয়ে বহু সাম্প্রদায়িক বিবাদের ইতিহাস পাওয়া যায়। এমনকি দীর্ঘদিন আমাদের অঞ্চলে কুরবানির ঈদকে বলা হতো ‘বকরি ঈদ’, কারণ ছাগল কুরবানিই ছিল প্রচলিত কুরবানির প্রাণী।
গরুর মাংসের অপর একটি অনুপস্থিতির কারণ ছিল এর উচ্চমূল্য। অধিকাংশ মানুষ বছরের অধিকাংশ সময় গরুর মাংস কেনা-খাওয়ার সামর্থ্যে ছিলেন না। যেখানে জিয়াফত হতো, সেখানেই তারা বিনামূল্যে আমিষ আহারের সুযোগ পেতেন। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী মিলেমিশে এই ভোজ বাংলার সামাজিক বন্ধন জোরদার করে।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান অনুষ্ঠানও এক ধরনের জিয়াফত। এটি পারিবারিক ও সামাজিক আয়োজনের পাশাপাশি চট্টগ্রামের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভোটের সময় বা কোনো বড় নেতার সফরে মেজবান অনুষ্ঠান বৃহৎ পরিসরে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জিয়াফত পেয়েছে একটি নতুন রাজনৈতিক অর্থ ও ভাষা। প্রথম আলোর কার্যালয় ঘেরাওয়ের সময় জিয়াফত আয়োজন হয়; ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ধ্বংসের পরেও সেখানে জিয়াফত অনুষ্ঠিত হয়। পরে রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনে বিজয়ের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে অনুষ্ঠিত জিয়াফতও স্মরণীয়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থকদের মধ্যে জিয়াফত আয়োজনের প্রবণতা বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনফ্লুয়েন্সার ও প্যারিস প্রবাসী অ্যাকটিভিস্ট ডা. পিনাকী ভট্টাচার্যকে এই ধরনের জিয়াফতের জনপ্রিয়করণের মূল ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়।
এভাবেই বাংলার সামাজিক ভোজ উৎসব থেকে আধুনিক রাজনীতির এক নতুন ভাষা হিসেবে ‘জিয়াফত’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে বিজয় উদযাপনে এর ব্যবহার এখন ঘনঘন লক্ষ্য করা যায়। আসন্ন নির্বাচন মরশুমে, কাঁচা টাকার ঝনঝনানি আর জিয়াফতের মিলনে এই সংস্কৃতি আরও ব্যাপক মাত্রা ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।