- হাসান শাওন
গরিবি দশা কে চায়? সচ্ছলতা, সম্পদের অধিকারি জীবন ও সম্পত্তির অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন সবারই। কিন্তু পথ খুঁজে বেড়ান বেশিভাগ লোক। খুব অল্পরাই পারেন স্বপ্নকে বাস্তব করতে। “দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” ঐ বেশিরভাগের জন্য এমন একটি বই, যা মলাট বন্দিত্ব ভেঙে বাস্তব জীবনে স্বপ্ন পূরণের রাস্তা চেনায়। সেনেগালে জন্মানো উদ্যোক্তা ও লেখক ওউমার সোল লিখিত ১০ টি নীতির আলেখ্য বইটি মোহাম্মদ আবদুল লতিফ এর বাংলা তর্জমায় ১৬২ পৃষ্ঠা আর দাম ৩৯০ টাকা। কিনে মূল বইটি পড়া ভালো। তবে তা খরচ ও সময় সাপেক্ষ যাদের কাছে , তাদের সম্পদ অর্জনে করণীয় বিষয়গুলো জানতে এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া জরুরি ।
“দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” নামে বইটি সাড়া জাগানো ও স্বতন্ত্র বহু কারণে। আজকের দিনে মুসলিম উম্মাহর পরিচয় হীন, দরিদ্র, পরাজিত একমাত্র আখিরাত সর্বস্বতায়। এ বই অনবদ্য হয়েছে এর পাল্টা বয়ান উপস্থাপনে। কেবল কল্পনাবিলাস লেখকের আশ্রয় নয়। অবলুপ্ত ইসলামের গৌরবের ইতিহাস এখানে উত্থাপিত। মানে বইটি ইতিহাস নির্ভর তা বলা হচ্ছে না। এই যুগে বিশ্বের অন্যতম সেরা বিত্তবান ১০ মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউরের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎ ও বাণিজ্যের অভিজ্ঞতার প্রকাশ বইটির চুম্বকীয় উপাদান। আরও সহজে বললে সম্পদ অর্জনের গাইডলাইন এই বই। এ যাত্রা কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস মেনে মুমিনদের কাঙ্খিত স্থায়ী গন্তব্য জান্নাতুল ফেরদৌস বাদ রেখে নয়। একই সাথে এ রচনা একজন ব্যক্তির আবার সমষ্টিরও। কারণ, মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব নিয়ন্ত্রক স্থান অর্জনে অতীত বিবরণ, বর্তমান বর্ণনা ও ভবিষ্যতের প্রকল্প লেখক সমন্বিত করেছেন “দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” নামের এই লিখিত সৃষ্টিকর্মে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পবিত্র কুরআন যেমন আল্লাহ সমগ্র মানবজাতির জন্য নাজিল করেছেন, তেমনই বইয়ের নামে “মুসলিম” শব্দটি থাকায় অমুসলিমদের একে পরিত্যজ্য ভাবার কারণ নেই।
লেখক ওউমার সোলই বোধ করি আলোচ্য বইটিতে এত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন কেন ইসলাম দারিদ্র দশা পছন্দ করে না। আরও সুস্পষ্ট করেছেন অন্যের অধীনতামূলক বৃত্তি অপেক্ষা কেন আল্লাহ ব্যবসাকে মহিমান্বিত উল্লেখ করেছেন। ব্যর্থতা, বিষন্নতা আর হতাশা ভরা মন জেগে উঠবে এ বইয়ে উল্লেখ করা মুমিনের এক দারুণ ব্যাখ্যায়। যা লেখক ওউমার নন বরং সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক আল্লাহর কথা- “যে ঈমান এনেছে সে ইতিমধ্যে অর্ধেক সফল হয়েছে।”
যে ১০টি নীতিতে “দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” বইটির বিন্যাস তা হলো –
১. ইসলাম ও সম্পদ। ২. একটি সফল দর্শন শাস্ত্রের জন্য প্রয়োজন। . ৩. প্রবণতা। ৪. লক্ষ্য ৫. বিশ্বাস। ৬. গ্রুপের শক্তি। ৭. কাজের ইথিকস। ৮. অধ্যাবসায় এবং অভ্যাস। ৯. ক্রিটিক্যাল স্কিল। ১০. সম্পদ গড়ার কৌশল।
সংক্ষেপে এই ১০টি অধ্যায়ের মূল প্রাধান্যগুলো উল্লেখ করা হবে।
প্রিন্সিপল ১ – ইসলাম ও সম্পদ :
এ অধ্যায়ে লেখক তার চিন্তা বিস্তার করেছেন যে সমাজে দ্বীন ইসলামকে পূর্ণতা দানকারী রাসুল মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন ও তাঁর ওপর ঐশী কুরআন নাজিলের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের কয়েকটি চিহ্ন ধরে। এর মধ্যে আছে আরবের উপদ্বীপের ব্যবসায়ীদের গৌরবের ঐতিহ্য। প্রাচীন সময়ে আরব বণিকদের ব্যবসা সুদূর চীন, ইউরোপের স্পেন ও পশ্চিম আফ্রিকার ভূগোলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু রাসুল (সা.) – কে প্রেরণের আগের সেসব ব্যবসা ও গোটা সমাজ ছিল সুদ নির্ভর। বহু অনাচারের নেপথ্য কারণ যে সুদের হারামের কথা বারবারই বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। সুদ বিলুপ্ত করা ইসলামী সমাজের অন্যতম লক্ষ্য। অশান্ত-গোত্রে বিভক্ত-রূঢ় প্রকৃতির আরব উপদ্বীপ পেরিয়ে ইসলাম সামাজিক ন্যায় বিচার ও দীর্ঘমেয়াদী পরিষেবায় সুবিধাজনক হয়ে ওঠে আরও দূরান্তের জনপদে। একইসঙ্গে “বাণিজ্যের বিশ্বায়ন ঘটেছে মুসলমানদের দ্বারা” – লেখক ওউমারের এমন উক্তিতে দ্বিমতের সুযোগ নেই।
ইসলাম নির্দেশিত সামাজিক ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ কীভাবে বর্তমানের ধনী মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউররা কাজে লাগাচ্ছে এর উদাহরণ হিসেবে লেখক বলেছেন তার সাথে কানাডার অন্টারিওর উদ্যোক্তা আজিম রিজভির আলাপের কথা। এ ধনী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে তার ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান “দ্য মুসলিম লিগাসি উইং” – মাধ্যমে লাভজনক উচ্চতায় পৌঁছে যান।
ব্যক্তি রাসুল (সা.) যে পরিচয় গুরুত্ব পেয়েছে তা ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা পরিচয় বাদ রেখে নয়। অতি শৈশবে অনাথ নবী মেষ পালন করলেও ব্যবসায়ী কুরাইশ পরিবারে জন্মে তিনি পূর্বসূরিদের পথে হেঁটেছেন। তাঁর ব্যবসা ছিল সুতার। মাত্র ১২ বছর বয়সে সিরিয়ায় যান তিনি চাচা আবু তালিবের বণিক বহর নিয়ে। সে অভিজ্ঞতা তাকে উদ্যোক্তা ও রাষ্ট্রনেতা হতে সহায়তা করে পরিণত বয়সে।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উওমার সোল আলোপাত করেছেন কুরআনের প্রথম নাজিল হওয়া সুরা আলাকের ১ নং আয়াত –
“পড়ো আপনার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।”
ব্যবসা ও জীবন চলার পথে প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞান ও ব্যবসা-পথের খুঁটিনাটি জানা অপরিহার্য। আরও দুটি বিষয় লেখক কিছুটা ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কুরআন সুন্নাহমাফিক তার মতে মুসলমান মানেই যিনি আল্লাহর দাস। এর অর্থ তিনি আল্লাহর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম মানতে বাধ্য। আর এই প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে রিজিক বা ভরণপোষণ, আর তা প্রযোজ্য সকল মাখলুকাতের জন্য।
যে ব্যক্তি ইসলামী অনুশাসনে অভ্যস্ত তার কাছে যাকাতের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। অর্জন করা সম্পদের অবিনিয়োগকৃত ২.৫ শতাংশ দরিদ্রদের মধ্যে এমনভাবে বিতরণ করতে হবে যাতে তারা দারিদ্র মুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। ইসলামের স্বর্ণযুগে যাকাত আদায়ে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী ব্যবহারের কথাও উল্লেখ আছে। লেখক উওমার সোল এ প্রসঙ্গে অভিমত এমন যে, যাকাত সুদের ব্যবস্থাকে উৎপাটন করে বহুমাত্রিকভাবে ব্যবসা বৃদ্ধি করে গোটা সমাজকে নিরাপদ রাখে।
প্রিন্সিপল ২ : একটি সফল দর্শনশাস্ত্রের জন্য প্রয়োজন :
ইসলাম ধনী হওয়াকে সবসময় উৎসাহ দেয়। কারণ ধনী হওয়ার গুরুত্ব হচ্ছে তাতে গ্রহীতার বদলে দাতা হওয়া যায়। গ্রহীতার হীনভাব আর দাতার তৃপ্তির মধ্যে তুলনা হয় না। এছাড়া অন্য বিষয়ও জড়িত এর সাথে। রাসুল (সা.) এর হিজরতের সময় মদিনা শহরের প্রেক্ষিতে বিষয়টি লিখেছে “দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” বইয়ের লেখক ওউমার সোল। সে সময় নিপীড়িত লোকদের ঠাঁই পাওয়ার স্থান হিসেবে বিবেচিত ছিল শহরটি। মক্কা থেকে আসা মুসলিমদের তখন শক্ত আশ্রয় চাই। ইসলামের অস্তিত্বের স্বার্থের তা দরকার। রাসুল (সা.) মসজিদে সারাক্ষণ অবস্থানরত সাহাবাদের চেয়ে ধনী সাহাবিদের পছন্দ দিতেন। আর যে সাহাবারা গরিব অবস্থায় আছে, তাদের গুরুত্বের সাথে ধনী হওয়ার পরামর্শ দিতেন।
ভালো ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার জন্য মনের প্রাচুর্য্য দরকার মনে করেন লেখক। এটি বিনিয়োগের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়।
ইসলামী অর্থশাস্ত্রের প্রধানতম ভিত্তি বলা যায় যাকাতকে। লেখক ওউমার আলোচ্য বই এর নাম দিয়েছেন “অর্থনৈতিক জ্বালানী”। অবস্থাসম্পন্ন মুসলমানদের জন্য এটি ফরজ অর্থাৎ অবশ্য পালনীয়। এর প্রাপ্যদের মধ্যে আছে দরিদ্ররা, ভ্রমণকারী এমনকি অসুস্থ ব্যক্তিরা। পবিত্র কুরআনে যতবার নামাজ কায়েমের কথা বলা হয়েছে, ততবারই যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বইয়ের এ অংশের আরেকটি বিষয় হচ্ছে ইসলামে ব্যবসার মানে সাবলীল ব্যাখ্যায়। আল্লাহ জ্বিন ও মানবজাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর সেই ইবাদতই আল্লাহর কাছে গুরুত্ব পায় যা সঠিক উদ্দেশ্যে ও সর্বোত্তম উপায়ে করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আদ-দুহার ১১ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে – “এবং আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহ হিসেবে এটি ঘোষণা করুন।” সুতরাং যিনি সম্পদের অধিকারী তিনি যেন ব্যবসায় অর্জিত লাভকেও এভাবে দেখেন। আরেকটি বিষয় লেখক উল্লেখ করেছেন যা ইসলামে ব্যবসায়ে নৈতিকতাকে অন্যভাবে পরিচিত করায়। আল্লাহর কাছে গ্রহনীয় সেই ইবাদত যা হালাল। তাতে ব্যবসায়ীরা সতর্ক থাকবেন ব্যবসায়ে বিচ্যুতির বিষয়ে। ব্যবসায়ে বা যেকোনো কাজে যেমন সাফল্যে সংক্ষিপ্ত পথ নেই। তেমনি যেন তেন ভাবে কোনো ইবাদত সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা আল্লাহর কাছে উপস্থাপনযোগ্য নয়।
ইসলাম ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে কতখানি গুরুত্ব দেয় এ প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন বিয়ে করা, স্ত্রীসহ পুরো পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা ও সন্তান জন্মদান ইবাদত।
হচ্ছে না, হবে না- এমন আশাহতভাব ইসলামে গ্রহণীয় নয়। ওউমারের মত এ নিয়ে সফলতা অর্জন শেথা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি একদা লন্ডন শহরের রাস্তার বাসচালক স্যার আনোয়ার পারভেজের কথা লিখেছেন। যিনি পরবর্তী জীবনে বিলিওনিয়ার হয়েছেন।
“দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” বইয়ে লেখক ওউমার উল্লেখ করেছেন হাজার বছর আগে আবু ইবনে জাফর আল দাউদীর রচিত আরবি ভাষার কিতাব “কিতার উল আমওয়াল (সম্পদের বই)” যেটি প্রাচ্যের লোকেরা পর্যন্ত পাঠ করেছে। পরের সময় পশ্চিমারা এ ক্ষেত্রে অনেককে ছাড়িয়ে গেছে। এ জায়গায় এসে লেখক পশ্চিমদের প্রতি কোনো রকম সমালোচনামূলকভাব প্রকাশ করেননি। বরং তিনি লিখেছেন, “সমালোচনার পরিবর্তে জ্ঞানে যুক্ত করুন। সমালোচনার মধ্যে হীনমন্যতা সহজাত।”
বেশ কজন মুসলিম মিলিওনিয়ারের উত্থান পর্যালোচনা করেছেন লেখক। খুব সংক্ষেপে এ নিয়ে কথা-
আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী অ্যালিকো ডাঙ্গোট পড়াশোনা করেছেন মিশরের বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। উত্তর আমেরিকার অন্যতম ধনী প্রতিষ্ঠান মির্জা ব্রাদার্স। যেটি সূচিত হয়েছে ড. ইয়াকুব মির্জার হাত ধরে। মিশরের সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জাঘলল ব্রাদার্স কানাডায়ও ভালো ব্যবসা করেছে। ওউমার লিখেছেন তুরস্কের মিসেস সেলভা গুড়োগানের কথা। এসেছে লন্ডনের ডাক্তার আমিনা কক্সন, পাকিস্তানের টাটা টেক্সটাইল, কাতারের রেডকো প্রতিষ্ঠাতা ফারুক শেখ ও সেনেগালের মি. জামিল প্রসঙ্গ। আরব উপদ্বীপের রাজকুমার কাতারের আল ওয়ালিদ বিন তালাল ৩০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ সাদাকার কথা।
প্রিন্সিপল: ৩ – প্রবণতা
আশাবাদী মানুষের ধর্ম ইসলাম। ঈমানের পরেই এই আশাবাদের স্থান। লেখক ওউমার একে অপটিমিজম আখ্যায় ব্যবসায় খাতেও এর প্রয়োজন আছে বলে লিখেছেন। উদাহরণ দিয়েছেন সেলেগালের উদ্যোক্তা ওমো এনডিএ-এর ব্যবসায় সফল হওয়া বিষয়। যিনি ফলিত গণিত অধ্যায়নের জন্য ফ্রান্সে যান। পাঠ জন্মভূমিতে ফিরে ব্যবসায়ও সফল হন। ইন্টারনেট ব্যবসায় তিনি দাম ও গুণমান বজায় প্রতিযোগীদের চেয়ে এগিয়ে যান। নিজের সফল হওয়া প্রসঙ্গে যিনি আশাবাদে ভরসা কথা অস্বীকার করেননি। ওমো বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি আমি এটা করতে পারি।”
সফল মুসলিম উদ্যোক্তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভালোর প্রচার একই সাথে মন্দকে এড়িয়ে যাওয়া। সে সঙ্গে অন্য যে কিছুর মতো ব্যবসায় ভালো করতে সময় নষ্ট না করা গুরুত্বপূর্ণ।
ওউমার তার এ বইয়ে ব্যবসায় ভালো করার জন্য ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ওপর জোর দিয়েছে। যার মানে আস্থা অর্জন। নবী (সা.) – এর জীবন-যাপন সম্পর্কে জানলে দেখা যায় তাঁর ওপর আল্লাহর কিতাব কুরআন নাজিলের আগেই তিনি তৎকালীন সমাজে সৎ গুণের কারণে খ্যাত ছিলেন। তাঁর আরেক নাম ছিল আল-আমিন (বিশ্বস্ত)। শুধু তিনি নন, ইসলামের আরবের প্রসিদ্ধ বণিক ও মুসলমানদের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) পরিচিত ছিল আল-সাদেক (সত্যবাদী) নামে।
সে গৌরবের যুগের শিক্ষা থেকে বর্তমানের সকল ক্ষেত্রের মতো ব্যবসাকেও ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ, ব্যবসায় যাকে Brand বলা হয়, এর সংজ্ঞা মূলত Brand is a trust to the consumer. যেকোনো ব্যবসায় এই ট্রাস্ট বিল্ডিং খুব জরুরি বিষয়। লেখক এ প্রসঙ্গে হালের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেটের কথা উল্লেখ করেছেন। যিনি বলে থাকেন যে, তার সমস্ত আর্থিক লেনদেন বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আছে।
“দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” – বইয়ে একই বিষয়ে অভিন্ন মত লেখকের কাছে প্রকাশ করেন আমানাহ মিউচুয়াল ফান্ডের প্রধান নির্বাহী ড. ইয়াকুব মির্জা। প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা তার বাবার হাত ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া নির্বাসী এ উদ্যোক্তা বলেছিলেন যে, তার ব্যবসার বেলায় তিনি দেখেছেন যার যা দেওয়ার কথা সে বলে তাতে আস্থা রাখার ওপর ব্যবসা দাঁড়িয়ে থাকে। ড. মির্জা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের সম্পর্কে বলেন যে, আস্থা ও অখণ্ডতার ওপর ব্যবসা পরিচালিত হয়।
বরেণ্য চক্ষু চিকিৎসক ও উদ্যোক্তা কানাডা নিবাসী ডা. ইকে আহমেদও তার প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক সফলতায় এই আস্থা নির্মাণের কৌশলকে কাজে লাগান বলে লেখক ওউমার সোলের কাছে স্বীকার করেন। তিনি রোগীদের যদি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন না হয়, তবে “না” বলেন ও তাদের থেকে টাকা নেন না।
এই সত্য, সরল পথে চলা ও আস্থা অর্জন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি । পবিত্র কুরআনের সূরা আশ-শু’আরার আয়াত ১৮১-১৮৩ – তে ইরশাদ হয়েছে –
“মাপে পূর্ণমাত্রায় দেবে এবং পরিমাণে কম দেয়, তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” “আর পূর্ণ ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়।” “মানুষকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটাবে না।”
ব্যবসায় সাফল্যের জন্য ব্যক্তিজীবনেও নবী (সা.) যেভাবে চলতেন তার অনুশীলন জরুরি। এর কয়েকটি নমুনা সংক্ষেপে বলা যায়। যেমন- যেকোনো কিছুকে সহজভাবে দেখা, হাস্যরসের উপস্থিতি কারণ, নবী (সা.) তার মৃদু হাসির জন্য পরিচিত ছিলেন এবং খারাপ সময়েও তা বহাল রাখা। ব্যক্তির ক্ষমতা খুব সীমিত কারণ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটান আল্লাহ। তাই সৃষ্টিকূলের অধিশ্বর আল্লাহকে সর্বক্ষেত্রে স্মরণ দরকার। আর এতে বিফলতার সুযোগ নেই। কারণ, বিষয়টি একপাক্ষিক নয়। যার নিশ্চয়তা দিয়ে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আমি তেমন যেমন বান্দারা প্রত্যাশা করে থাকে। আমিও তাদের সাথে থাকি যখন বান্দারা আমাকে স্মরণ করে থাকে। তারা যদি আমাকে নিয়ে ভাবে আমিও তাদের নিয়ে ভাবি।” এই বিষয়ের সঙ্গে যার যোগ আছে তা হচ্ছে “তাকওয়া” এর মানে আত্মরক্ষা, নিষ্কৃতি লাভ করা, ভয় করা। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অপরাধ, অন্যায় ও তিনি যেসব অপছন্দ করেন সেসবে না জড়ানো।
লেখক ওউমার লিখেছেন, “কুরআনে যে সমস্ত ভালো চরিত্র দেখি তাদের মধ্যে ধৈর্য্য হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অধৈর্য্যতা সকল পাপের প্রবেশদ্বার।” ব্যবসায় সফল হতেও এর বিকল্প নেই । এ প্রসঙ্গে লেখক ব্যবসায়ী ইয়াকুব মির্জার ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্জন, আফ্রিকার বিপুল বিত্তবান আলিকো ডাঙ্গোর প্রথম ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন। “প্রবণতা” প্রিন্সিপলের শেষ পর্যায়ে লেখক সাইকেল চালানোর শুরু সঙ্গে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো তুলনা দিয়ে লিখেছেন, “আপনি যদি প্রথমবার সাইকেল চালান তবে আত্মবিশ্বাস বোধ করা খুব কঠিন হবে। তবে আপনি যদি এটি বহুবার করে থাকেন এবং বাইসাইকেলটি নিয়ে শহর ঘুরে থাকেন তবে আপনার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। ব্যবসাও আলাদা কিছু নয়। ”
প্রিন্সিপল : ৪ – লক্ষ্য
আলোচ্য বইয়ের এ অধ্যায়ে লেখক ওউমার বড় লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্ব দিয়েছেন। যার সঙ্গে যোগ আছে দক্ষতার। কারণ, আল্লাহ দক্ষতা পছন্দ করেন। দুবাইভিত্তিক সফল উদ্যোক্তা আরিফ মির্জা এ প্রসঙ্গে বলেন, “আল্লাহ অনেক কিছু করেন। তার কাছে বড় কিছু চাইব না কেন?” তার মতে এটি প্রত্যেক মুসলিম উদ্যোক্তার মানসিকতা হওয়া উচিত।
জীবন ও ব্যবসায় সাফল্যের জন্য চরমতম সত্য বিষয় উল্লেখিত এ অধ্যায়ে। কথাটি সম্পদ উপার্জনকারী এন্ট্রাপ্রেনিউররাও স্বীকার করেছেন। তাহলো, “আপনার আরাম অঞ্চলটি আপনার দেউলিয়া অঞ্চল।” ব্যবসায় শীর্ষে থাকার জন্য লক্ষ্য যেমন বড় হতে হবে তেমনি বিসর্র্জন দিতে হবে নিজের আরামকে। সাফল্যের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে নিজের সফল হওয়া অভিপ্রায় অন্যতম। সঙ্গে একটি বিষয় জরুরি নিজের মন পরিষ্কার রাখা। প্রয়োজন ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় দেওয়া বাদ পরিহার করা উচিত।
মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউরদের অধিকাংশ আলোচ্য বইয়ের লেখক ওউমার সোলকে বলেছেন সালাতের গুরুত্ব। তারা নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। নামাজের সময় ভিন্ন ভিন্ন। এর ফলে আল্লাহর কাছে প্রার্র্থনা ও তাঁর নির্দেশ যেমন মান্য করা হয়, তেমনি ভিন্ন লক্ষ্য পূরণে কল্পনার সহায়তা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ফলাফল লাভে দয়াময় আল্লাহর কাছে সরল সহজ পথ প্রাপ্তির সুযোগ থাকে।
আরেকটি বিষয় এ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে, সেটি হলো মন নিয়ন্ত্রণ। মনের স্থিরতা ছাড়া কিছু সম্ভব না। এজন্য মানুষের যেকোনো কাজে সাফল্যের জন্য মন নিয়ন্ত্রণ জরুরি। আর আল্লাহ এ ক্ষমতা মানুষকে দিয়েছেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে দোয়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গ। পবিত্র কুরআনের সূরা আর-রহমানের আয়াত- “তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন।” উল্লেখ করে ওউমারের ভাষ্য এমন যে, আল্লাহ মানুষকে এককভাবে শব্দ দিয়েছেন, কথা বলার শক্তি দিয়েছেন। বেশিরভাগ অসুস্থতা জীবাণুর কারণে নয়। বরং মানুষের কথার কারণে। আবার দোয়ার বেলায় বিষয়টি এমন যে তা শুধু মনে মনে ভাবা হয় না। মুখেও জিভের সাহায্যে উচ্চারণ করা হয়। আর দোয়া কবুল নিয়ে পূর্বে উল্লেখ করা দুবাইয়ের সফল উদ্যোক্তা আরিফ মির্জা বলেছেন, “যখন আল্লাহ নীচে নেমে আসেন এবং তিনি লোকদের সন্ধান করেন এবং আমি তাদের একজন হতে চাই। আমি বলতে চাই যে, আমি এখানে আছি আমাকে দিন।” প্রাসঙ্গিক একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে, “যে মুসলমান আনন্দিত হলেও আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয়, বিবাদে ধৈর্য্য ধরে- উভয়ক্ষেত্রে তাকে পুরস্কৃত করা হয়।” ইতিবাচক চিন্তার গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, “বান্দা যখন ভালো চায়, তখন আল্লাহ তার জন্য ভালো কিছু ঘটান।” দুনিয়ার জীবনে মানুষের ইচ্ছা আল্লাহর কাছে দাস তুল্য। ইতিবাচকতা গুরুত্ব এখানে আর আল্লাহ প্রতি নির্ভরতার উৎসও এখানে মেলে।
বইয়ে সফল বণিকদের সঙ্গে কথা বলে সঠিক একটি রাস্তার খোঁজ দিয়েছেন ওউমার। তাহলো ব্যবসার জন্য চারদিক না হাতড়িয়ে একটি লাইন খুঁজে নেওয়া। সেক্ষেত্রে সাফল্যের পথ খুঁজে নেওয়া আর এর জন্য অধ্যাবসায়ী হওয়া। এটিই শীর্ষে ওঠার রাস্তা। আরেকটি বিষয় ইসলামী জীবন-যাপনে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো পরিবারের পেছনে খরচ করা। স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের পেছনে ব্যয় করাকে ইসলাম উৎসাহ দেয়।
ওউমার এনটিজি ক্ল্যারিটি ইনক এ প্রতিষ্ঠাতা পাকিস্তানের সফল উদ্যোক্তা ইমাম আশরাফ জাগলোল এর সঙ্গে আলাপের একটি বিষয় তুলে ধরে লিখেছেন যে, ব্যবসা সফল এই উদ্যোক্তা বলেন, “ইস্তেগফার “ম্যাজিক্যালি” সম্পদ বৃদ্ধি করে।” আরেকটি বিষয় সফলতা পাওয়া মুসলিম উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ইসলাম ম্যানিমালিস্টিক বলে কিছু গ্রাহ্য করে না। সংক্ষিপ্তবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে রাসুল (সা.) এর এই হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে, “জান্নাত চাইলে তোমরা জান্নাতুল ফেরদৌসই চাইবে।” ব্যবসার ক্ষেত্র ভিন্ন নয়। সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য চেষ্টা করতে হবে। এর মধ্যে কোনো মাইলফলক এলে তা উদযাপনে বাঁধা নেই।
প্রিন্সিপল: ৫ – বিশ্বাস
ঈমান মানে বিশ্বাস। এই ঈমান ছাড়া কিছুর প্রাথমিকতা নেই ইসলামে। একজন ধর্মান্তরিত নারী মুসলিম ড. আমিনা কক্সন বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন পবিত্র কুরআনের সূরা আল-বাকারার ২ নং আয়াত দিয়ে।
“এটি সেই গ্রন্থ যা সম্পর্কে সন্দেহ নেই . . .” এ আয়াত প্রকাশ করে যে দৃঢ় বিশ্বাস ইসলামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সফল মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউররা ব্যবসার বেলায় এই বিশ্বাস যেমন প্রয়োগ করেন তা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রত্যয়ও দেখান।
ধনী হওয়া জন্য ধনী বোধ করারও দরকার আছে। দরিদ্র ব্যক্তির মতো চিন্তা চিন্তা করলে দরিদ্র থাকতে হবে। নিজেকে বলতে হবে, আমি বিজয়ী। এর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য আছে। কারণ, বীর্যের মিলিয়ন কোষের মধ্য থেকে একটি কোষে মানুষের জন্ম হয়। মুসলমানদের মতে এই সন্তান জন্মদানও একটি ইবাদত। এটি তাদের জন্য সম্মান। আল্লাহ বলেছেন, “আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।”
সম্পদ নিয়ে ইসলামের দর্শন এখানে প্রকাশিত। সম্পদ দুনিয়ায় অসীম। এখানে কোনো দরিদ্র দেশ, দরিদ্র জাতি বলে কথা নেই। এমন কথায় প্রকারন্তে সৃষ্টি রহস্যের দারিদ্র প্রকাশ পায়। তাই সম্পদ আছে প্রচুর তা খুঁজে নিতে পরিশ্রম করতে হবে। এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে ধনী হওয়ার জন্য বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন নেই। যে যেখানে আছে সেখান থেকেই ধনী হওয়া সম্ভব। প্রয়োজন বৃত্ত বদল। যিনি যে ক্ষেত্রে সফল হতে চান সেক্ষেত্রে থাকা শীর্ষ লোকদের মতো সততার সঙ্গে চলার চেষ্টা করা উচিত। সফল উদ্যোক্তাদের পরামর্শ এমন যে, শুরুতে নিজ এলাকার ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।
প্রিন্সিপল: ৬ – গ্রুপের শক্তির
ইসলামে প্রথম অগ্রাধিকার দেওয়া হয় রক্তে সম্পর্কে আপন আত্মীয়দের। এই আত্মীয়তার বন্ধনকে প্রতিটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয় “সিলাতুল রাহম” অর্থাৎ পবিত্র কিছু বলে।
ব্যবসার ক্ষেত্রেও এটি খুব গুরুত্বপূর্র্ণ। অনেক সফল ব্যবসায়ী গ্রুপ পরিবার দ্বারা পরিচালিত। প্রায় ক্ষেত্রে হয় এমন হয় যে ব্যবসায়ের প্রথম পুঁজির জোগানদার পরিবার। এই রক্ত সম্পর্কগুলো সব সম্পর্কের চেয়ে অধিক শক্তিশালী সম্পর্ক। সফলতার জন্য কীভাবে আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো আরও সাধারণভাবে বলা যায় এন্টারপ্রাইজটি কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সে জন্য এই সম্পর্কগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করা উচিত। এই পরিবার গোষ্ঠীর শক্তি নবী (সা.) নিজেও জরুরি মনে করতেন। এমন বলা আছে, রক্তসম্পর্কের বন্ধন ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। গ্রুপের শক্তি বলতে ইসলামের কাছে বাইরের কেউ নয় বরং রক্ত সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু বিরাজমান পরিবার নয়, আরও পেছনে গিয়ে বংশ ধারার মধ্যেও সৎ ব্যক্তি ও কাজের উপাদান শনাক্ত করে নিজের তাৎপর্য আরও উপযুক্ত করা যায়। যেটা বলা হয়ে থাকে “ফ্যামিলি ট্রি” এটি কোনো অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। “উপজাতি” শব্দটি ব্যবহার নিয়ে একেকজনের একেক মত। সে বিতর্কে না গিয়ে দেখা যায় তাদের মধ্যে বন্ধন অত্যন্ত নিবিড় ও দৃঢ়। ওউমার হিজরতের বেলায়ও ঋণ পাওয়ার উৎসের ক্ষেত্রেও পারিবারিক সম্পর্কের কথা লিখেছেন।
বিশ্ব নিয়ন্ত্রক অনেক করপোরেশনই পারিবারিক। এক্ষেত্রে সফল মুসলিম উদ্যোক্তাদের পরামর্শ হচ্ছে নিজেদের ভাতৃত্বের বন্ধন কাজে লাগানো। সাফল্যের জন্য বেশি চেষ্টা করা। মিলিয়ন ডলার কোম্পানিকে বিলিয়ন ডলারে রূপান্তরের লক্ষ্যে শ্রম নিংড়ে দেওয়া। ব্যবসার পরামর্শের বেলাও দেখা যায় পরিবার থেকে সফল হওয়া রাস্তা বের করে দেওয়া হয়। ওউমার তার বইয়ে এই পারিবারিক শক্তি গুরুত্ব তুলে ধরতে সূরা আল-ইমরানের ১০৩ নং আয়াত উল্লেখ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে –
“একসাথে আল্লাহর দড়িকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।”
সফলতার জন্য জামায়াতে ঐক্যবদ্ধতার দিকে প্রসঙ্গ এসেছে। বিয়েকেও সম্পর্ক বাড়ানো একটি পথ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সম্পদের অংশীদারিত্ব নিয়ে একই পথরেখার নির্দেশ অনুসৃত হয়েছে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায়।
এক পর্যায়ে ওউমার Ed Marsa এর The 8th Grade Milllonaire বইটির নাম উল্লেখ করেছেন। বারবার তার সঙ্গে আলাপে ধনী মুসলিম উদ্যোক্তারা বলেছেন, “সাফল্য একটি অভ্যাস, ব্যর্থতাও তাই।”
মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান Redco দোহার সহ-প্রতিষ্ঠাতা মতোজিব উর রহমানের মতে, “প্রত্যেক মুসলমানের উচিত ব্যবসা করা।” কারণ, চাকরি মানে আরেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনতা। এর মাধ্যমে উন্নতি ও সম্পদ অর্জন অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কিন্তু পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে ব্যবসার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, তিনি সুদকে হারাম করেছেন আর ব্যবসাকে করেছেন হালাল। আর এই যে বিষয় হালাল বলা হয়েছে তাতে নিজেদের পরিবারকে যুক্ত করায় ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে পালনীয়।
প্রিন্সিপল: ৭ – কাজের ইথিকস
“দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রিনিউর” বইয়ের এ লেখক ওউমার সোল লিখেছেন, “কাজকে ইবাদতে অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়; একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। অ্যাকশনে থাকা এবং কাজ করা সদর্থক। এটি নবীসুলভ উপায়।”
নবীদের জীবনে দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারা প্রত্যেকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। এটি মহান আল্লাহ-তায়ালারই পরিকল্পনা। ওউমার এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এর পেছনে যে বুদ্ধি ছিল তা হতে পারে যে এটি ধৈর্য্য শিখিয়ে থাকে।”
প্রিন্সিপল: ৮ – অধ্যাবসায় ও অভ্যাস
অন্য সব কাজের মতো অধ্যাবসায় ছাড়া প্রাপ্তি লাভ সম্ভব না। কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর জীবন সহজ নয়। বহু ভোগান্তি সয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ওউমার মতোজিব উর রহমান ও সেনেগালের ছাতা ব্যবসার উদ্যোক্তা মি. ইয়া এনডিয়ানরের জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন। যাদের কারাবরণের অভিজ্ঞতা আছে। তবে দুজনই পরে ব্যবসায় সফল হয়েছেন।
পরিস্থিতি যাই হোক সফলতার জন্য ব্যবসায় লেগে থাকতে হবে। এটি অভ্যাসে রূপ দেওয়া জরুরি। কারণ সফলতা শেষ পর্যন্ত আল্লাহই বন্টন করেন।
প্রিন্সিপল: ৯ – ক্রিটিক্যাল স্কিল
শিক্ষাকে “দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” বইয়ের লেখক ওউমার সোল দুইভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমত, তাত্ত্বিক শিক্ষা। দ্বিতীয়ত, ব্যবহারিক শিক্ষা। তিনি লিখেছেন, “এটি অনানুষ্ঠানিক এবং ‘স্ট্রিট স্মার্ট’ হিসেবে পরিচিত। আপনি নিজের ব্যবসা শুরু করে এটি পেতে পারেন।
লেখকের পরামর্শ হচ্ছে নিজের শখকে ব্যবসায় পরিণত করা। সে বিষয় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে যে জ্ঞান মেলে তা সে ব্যবসায় কাজে লাগান। এটি ছোটো স্কেলে শুরু করার পক্ষে মত দিয়েছেন ওউমার। এ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, “মনে রাখবেন : তাত্ত্বিক জ্ঞানের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হতে পারে। ব্যবহারিক জ্ঞান আপনাকে দীর্ঘমেয়াদে আরও সহায়তা করবে। তবে দুটোই পেতে কষ্ট হয় না।” এর জন্য যেটি দরকার তাহলো শেখার জন্য উন্মুক্ত থাকা।
ব্যবসায় নেতৃত্ব দেওয়া একটি দক্ষতা। এটি সময়ে সাথে সাথে শিখে নিতে হয়। আর প্রধান দক্ষতা লেখকের মতে বিশেষায়িত জ্ঞান। এটিও অর্জন করে নিতে নেওয়া আবশ্যিক।
প্রিন্সিপল: ১০ – সম্পদ গড়ার কৌশল
লেখক ওউমার সোল মনে করেন সম্পদ গড়ার সাথে জড়িয়ে আছে এক ধরনের প্রাজ্ঞতা। তা জেনেই এর জন্য তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন ইনকামের বহু স্ট্রিম তৈরির প্রতি। এর জন্য কোনো সংস্থার হয়ে কাজ করা যেতে পারে। সরাসরি ব্যবসায় সময় দেওয়া সম্ভব হলে তাতে দোষ কী? এছাড়াও পরিষেবা খাত থেকে উপার্জন আসে। বিক্রয়যোগ্য হলে সৃষ্টিকর্ম থেকে আয় আসতে পারে।
প্রথমে দরকার, ব্যবসাকে ভালোবাসা। তারপর নিজের শক্তির দিক বুঝে সেটি শুরু করা। দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহর তাই লেগে হবে প্রার্থনার সাথে। কারণ, তার অনুগ্রহ ছাড়া সফল হবে না কিছুই। সূরা আদ-দুহাহ-তে ইরশাদ হয়েছে, “এবং আপনার (হে নবী) পালনকর্তার অনুগ্রহ ঘোষণা করুন।”
“দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর” বইয়ের পাঠ-প্রতিক্রিয়া মূল বই পাঠে কাউকে উৎসাহী করলে এ লেখনী সার্থক বিবেচিত হবে। পাঠ শেষে উজ্জীবিত হয়ে কেউ ব্যবসায় সফল হলে লেখক ওউমার সোলের মৌলিকত্ববাহী এ বই আরও প্রাসঙ্গিক হবে বহু লোকের কাছে। তবে সত্যিকারের ইসলামের মূল দীক্ষাপথে যদি বইটি ধাবিত করে কাউকে তবে তিনি সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা করুনাময় আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠবেন তা বলাই বাহুল্য।
বই : দ্য মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর, গ্রেটেস্ট মুসলিম এন্ট্রাপ্রেনিউর থেকে ১০ সাকসেস প্রিন্সিপল
লেখক : ওউমার সোল
বাংলা অনুবাদ : মোহাম্মদ আবদুল লতিফ
প্রকাশনী : নোভা বুক অ্যান্ড পাবলিশার্স,
দাম : ৩৯০ টাকা
প্রচ্ছদ : তারেক মুনাওয়ার
প্রথম প্রকাশ : ২০২১
পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেন: লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হাসান শাওন