ইসলাম মুসলমানদের আমানতদারিতার প্রতি বিশেষ তাগিদ দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন যে তোমরা যেন প্রাপ্য আমানত প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও…।’ (সুরা নিসা, আয়াত, ৫৮)
পবিত্র কোরআনে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত, ৮)
ইসলামের দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি আমানত রক্ষা করে না সে মুনাফিক বা কপট। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে খাঁটি মুনাফিক এবং যার মধ্যে তার একটি দেখা যাবে তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থাকবে, যে পর্যন্ত না সে তা পরিহার করবে।
১. যখন তার কাছে কোনো আমানত রাখা হয় সে তা খেয়ানত করে।
২. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে।
৩.যখন ওয়াদা করে, ভঙ্গ করে।
৪.যখন কারো সঙ্গে ঝগড়া- বিবাদ করে, তখন সে অশ্লীলভাষী হয়।’ (বুখারি, হাদিস, ৩৪)
কোরআনের আয়াত এবং হাদিসের মাধ্যমে বুঝা যায় আমানত রক্ষা করা মুমিনের বিশেষ গুণ। মুমিন এবং মুনাফিকের মাঝে পার্থক্য গড়ে তুলে আমানত রক্ষা করা ও না করার বিষয়টি। যার মাঝে আনামত রক্ষার গুরুত্ব নেই তাকে হাদিসে স্পষ্ট শব্দে মুনাফিক বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আনামত রক্ষা না করার ভয়াবহ একটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তিনি বলেছেন, আমানতের খেয়ানত বেড়ে যাওয়া কিয়ামতের অন্যতম আলামত। অর্থাৎ শেষ জামানায় আমানতের খেয়ানত ব্যাপাকহারে বেড়ে যাবে। হাদিসের ভাষ্যমতে, অযোগ্য লোককে কোনো কাজের দায়িত্ব দেয়াও আমানতের খেয়ানতের অন্তর্ভূক্ত।
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো এক মজলিসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে নবীজীকে এই বলে প্রশ্ন করলো যে, কিয়ামত কখন হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা চালিয়ে যেতে থাকলেন।
এ কারণে কিছু লোক মন্তব্য করলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকটির এই প্রশ্নকে অপছন্দ করেছেন। আবার কিছু লোক বললো, তিনি তার কথা শুনতেই পান নি।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচনা শেষে বললেন, প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বললো, এই তো আমি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
إِذَا ضُيِّعَتِ الْأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ قَالَ كَيْفَ إِضَاعَتُهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ إِذَا أُسْنِدَ الْأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ
‘যখন আমানতের খেয়ানত হবে তখন কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে বলে মনে করবে। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, কিভাবে আমানতের খেয়ানত করা হবে? নবীজী বললেন, যখন অযোগ্য লোকদেরকে দায়িত্ব দেয়া হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করতে থাকো।’
আখেরী যামানায় যখন আমানতদারের সংখ্যা কমে যাবে তখন বলা হবে অমুক গোত্রে একজন আমানতদার লোক আছে। লোকেরা একথা শুনে তার প্রশংসা করবে এবং বলবে, সে কতই না বুদ্ধিমান! সে কতই না মজবুত ঈমানের অধিকারী! অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই। (বুখারি, অধ্যায়, কিতাবুর রিকাক, বুখারি, অধ্যায়, কিতাবুল ফিতান)
আরেক হাদিসে হজরত হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দুটি হাদীস বর্ণনা করেছিলেন, যার একটি আমি দেখেছি (বাস্তবায়িত হয়েছে) আর অপরটির অপেক্ষায় আছি।
তিনি আমাদের বলেন, আমানত মানুষের অন্তর্মুলে প্রবিষ্ট হয়। এরপর তারা কুরআন শিখে, তারপর তারা সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করে।
তিনি আমাদের আমানত বিলুপ্ত সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ এক সময় ঘুমাবে। তার অন্তর থেকে আমানত উঠিয়ে নেওয়া হবে। তখন একটি বিন্দুর ন্যায় চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। এরপর সে আবার ঘুমাবে। তারপর আবার তুলে নেওয়া হবে, তখন ফোসকার ন্যায় তার চিহ্ন অবশিষ্ট থাকবে। যেমন একটা জ্বলন্ত অঙ্গারকে যদি তুমি পায়ের উপর রেখে দাও এতে পায়ে ফোসকা পড়ে, তখন তুমি সেটাকে ফোলা দেখবে। অথচ তার মধ্যে কিছুই নেই।
(এ সময়) মানুষ বেচাকেনা করবে বটে কিন্তু কেউ আমানত আদায় করবে না। তখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন আমানতদার ব্যাক্তি আছেন।
কোনো কোনো লোক সম্পর্কে বলা হবে যে, লোকটি কতই না বুদ্ধিমান, কতই না বিচক্ষণ, কতই না বীর, অথচ তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান নেই।
এরপর হুযায়ফা হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, আমার উপর দিয়ে এমন একটি যুগ অতিবাহিত হয়েছে তখন আমি তোমাদের কার সাথে লেনদেন করছি এ সম্পর্কে মোটেও চিন্তা-ভাবনা করতাম না। কেননা, সে যদি মুসলিম হয় তাহলে তার দ্বীনই (হক আদায়ের জন্য) তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে। আর যদি সে খৃষ্টান হয়, তাহলে তার অভিভাবকরাই (হক আদায়ের জন্য) তাকে আমার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য করবে। কিন্তু বর্তমানে আমি অমুক অমুককে ছাড়া কারো সঙ্গে বেচাকেনা করব না। (বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, অধ্যায়, কিতাবুল ফিতান, হাদিস, ৬৬০৭, অধ্যায়, কিতাবুর রিকাক, হাদিস, ৬০৫৩)