মুফতি ইমাম মো: রেযাউল কারীম বুরহানী
এই পৃথিবীতে আমাদের আগমনের মাধ্যম পিতা-মাতা। আর এ পিতা-মাতা হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই জানা প্রয়োজন ইসলামে প্রতিটি শিশুর মর্যাদা, অধিকার, গঠন ও পরিচর্যা সম্পর্কে কী বলা আছে। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কখন থেকে একটি শিশুর অধিকার শুরু হয়? রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস অনুযায়ী বলা যায়, মাতৃগর্ভে আসার পূর্ব থেকেই একটি শিশুর অধিকার শুরু হয়ে যায়। আমরা যখন একজন জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী নির্বাচন করতে যাই, তখন থেকেই শিশুর প্রতি আমাদের দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। কেননা, শিশুদেরও অধিকার রয়েছে সৎ ও মহৎ মা-বাবা লাভ করার। একজন ভালো মানুষকে পিতা হিসেবে পাওয়ার, একজন মমতাময়ী নারীকে মা হিসেবে পাওয়ার, যারা তাদেরকে ভালোবাসবে এবং সত্যিকার ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।
পিতা-মাতা যদি সৎ ও চরিত্রবান না হন, তাহলে পৃথিবীতে শিশুর আসা বা জন্ম লাভ করাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। একটি শিশু যখন মায়ের গর্ভে ভ্রূণ অবস্থায় থাকে তখন এটা তার অধিকার যে, পিতা-মাতা তাকে সুন্দরভাবে এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দেবে, তাকে হত্যা করবে না; বরং গর্ভে থাকাকালীন সময়ে তাকে যথোচিত নিবিড় পরিচর্যা করবে। এটি সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত অধিকার। কারণ ধর্মীয় দৃষ্টিতে শিশু হত্যা মহাপাপ।
কুরআন ও হাদিসের তথ্য ও তত্ত্ব : ‘নভোজগৎ ও ভূ-জগতের আধিপত্য একমাত্র আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা শিশু উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছে তাকে করে করেন বন্ধ্যা। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (আল-কুরআন ৪২:৪৯-৫০)
‘হে আমার রব তুমি তোমার কাছ থেকে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দান করো। এ উত্তরাধিকার আমার ওয়ারিশও হবে এবং ইয়াকুবের পরিবারের মিরাসও পাবে। আর হে প্রভু! তাকে একজন পছন্দনীয় মর্যাদাবান মানুষ বানাও।’ (আল-কুরআন ১৯:৫-৬)
‘হে আমাদের প্রভু। আমাদের জন্য এমন জুড়ি ও সন্তান-সন্ততি দান করো, যারা হবে আমাদের জন্য নয়ন শীতলকারী এবং আমাদেরকে করো মুমিন-মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য নেতা।’ (আল-কুরআন ২৫:৭৪)
‘হে আমার প্রভু! তুমি তোমার কাছ থেকে আমাকে পবিত্র সন্তান দান করো। অবশ্যই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (আল-কুরআন ৩:৩৮)
আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন– ‘মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ ঈমান সে লোকই লাভ করেছে যার চরিত্র সর্বোত্তম এবং যিনি পরিবারের লোকদের সাথে কোমল আচরণকারী।’ (ইমাম তিরমিজি, আস-সুনান, অধ্যায় : আল-ঈমান, অনুচ্ছেদ: ফি ইস্তিকমালিল ঈমান, খণ্ড-৫, হাদিস নং- ২৬১২, পৃষ্ঠা : ৯)
আমাদের করণীয় : আজকের শিশু জাতির সোনালি ভবিষ্যতের স্থপতি। শিশুদের জন্য এমন সুন্দর পরিবেশ দান করুন যেন তারা সব সম্ভাবনাসহ সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে।
শিশুর অধিকার সম্বলিত উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তার সফল বাস্তবায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। এই বাস্তব সত্য উপলব্ধি করে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে শিশু অধিকারের উপর বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের নিরন্তর প্রচেষ্টা সবাইকে করতে হবে।
শিশুর অস্তিত্বের সঠিক মূল্য দিতে না পারলে অন্যান্য অধিকার কখনোই আদায় করা যাবে না অথবা অন্যান্য অধিকার আদায়ের সুযোগই পাওয়া যাবে না। কিংবা সুযোগ এলেও তার অধিকার আদায়ে সফল হওয়া যাবে না। কাজেই শিশুর সাথে সঠিক আচরণের জন্য তার যথার্থ মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হওয়া অত্যাবশ্যক।
পরিবারের সদস্য, স্ত্রী ও সন্তাদের সাথে সহিংস আরচণ না করে তাদের সাথে কোমল আচরণ করা আমাদের প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। তাহলেই আমরা মুসলমান, পরিপূর্ণ ঈমানদার ও সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠতে পারব।
উপসংহার : পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা যায়, শিশুসন্তান পিতা-মাতার জন্য জান্নাতের সুপারিশকারী হবে। পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও সু-সন্তানের আমল এমন এক সদকা হিসেবে পরিগণিত হবে, যার সওয়াব দুনিয়ায় থাকা পর্যন্ত তাদের আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। হাদিস থেকে জানা যায়, মৃত্যুবরণ করার সাথে সাথে মানুষের আমলের সুযোগ শেষ হয়ে যায়; কিন্তু সে যদি সুসন্তান রেখে যায় তাহলে তা এমন এক নেক আমল হবে, যার সওয়াব লেখা হতে থাকবে অনন্তকাল। উপরিউক্ত কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে শিশু-সন্তানের মর্যাদা ও মূল্য অপরিসীম এবং শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সঠিক গঠন ও পরিচর্যা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : ইমাম ও খতিব, দৌলতখান মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।