কওমী মাদরাসা আমার অহংকার

আব্দুল আজিজ কাসেমী

কওমী মাদরাসা। এই নামটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচায়ক নয়; এটি একটি আদর্শ, একটি আন্দোলন এবং এক অবিনাশী ধারা, যা ইসলামি শিক্ষা ও নৈতিকতার আলোকবর্তিকা হয়ে যুগের পর যুগ আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই মাদরাসাগুলোই আমাদের ঈমান, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের রক্ষাকবচ। তাই গর্বভরে বলতে হয়— “কওমী মাদরাসা আমার অহংকার।”

কওমী মাদরাসার ইতিহাস ও সূচনা:

উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে যখন ঔপনিবেশিক শাসকের আগ্রাসনে ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি নড়ে উঠেছিল, তখন কয়েকজন দূরদর্শী আলেম রহ. দ্বীনকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে ১৮৬৬ সালে ভারতের দেওবন্দে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলূম দেওবন্দ। যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কওমী মাদরাসা। সেখান থেকেই সূচনা ঘটে কওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার।

বাংলাদেশেও স্বাধীনতার আগে ও পরে এই ধারার আলেমগণ সমাজে ইসলামি শিক্ষার পুনর্জাগরণ ঘটান, গ্রামে-গঞ্জে গড়ে তোলেন হাজারো মাদরাসা—যেগুলো আজ লাখো ছাত্র-ছাত্রীর দ্বীনি তালীমের কেন্দ্রবিন্দু।

ধর্মীয় অবদান:

কওমী মাদরাসা দ্বীনের মূল শিক্ষার ধারক-বাহক। এখানে কুরআন, হাদীস, ফিকহ, তাফসীর, আরবি সাহিত্যসহ ইসলামী জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় গভীরভাবে পাঠদান করা হয়।
মাদরাসা থেকেই বের হয়েছেন আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, খতীব ও দাঈ—যাঁরা সমাজে ইসলামী আদর্শ প্রচার করে মানুষের ঈমান রক্ষা করছেন।
তারা মসজিদে ইমাম, মাদরাসায় শিক্ষক, সমাজে ন্যায় ও নৈতিকতার প্রহরী হয়ে কাজ করছেন। ফলে কওমী মাদরাসা ইসলামি জীবনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।

সামাজিক অবদান:

কওমী মাদরাসা শুধু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি সমাজ গঠনেরও কেন্দ্র।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করে, আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে—যা আজও বিরল এক মানবসেবা। মাদরাসার ছাত্ররা সমাজে দান-সাহায্য, ত্রাণ বিতরণ, জানাজা, বিবাহ পরিচালনা, সামাজিক সমস্যার সমাধানসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

গ্রামের মানুষ আজও জানে— “একজন আলেম মানেই একজন ন্যায়বিচারক, একজন বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক।”
কওমী মাদরাসার সবচেয়ে বড় অবদান হলো মানব গঠন। এখানে শিশুকে প্রথম দিন থেকেই শেখানো হয় সততা, পরিশ্রম, আদব, বিনয়, আল্লাহভীতি ও নৈতিকতার শিক্ষা।

এই শিক্ষা শুধু তথ্য দেয় না; বরং চরিত্র গঠন করে। যেখানে আধুনিক শিক্ষা অনেক সময় শুধু পেশা তৈরি করে, কওমী মাদরাসা তৈরি করে আদর্শ মানুষ—যে আল্লাহভীরু, দায়িত্বশীল, ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত।
এ কারণেই বলা হয়, “মাদরাসা আদর্শ মানুষ গড়ার কারখানা।”

বাংলাদেশে কওমী আলেমরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের নেতৃত্বেই কওমী শিক্ষা আজ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে—যা একটি ঐতিহাসিক সাফল্য।
দেশের প্রতিটি মসজিদ, মক্তব, দাওয়াতি সংগঠন ও সামাজিক উদ্যোগের পেছনে এই আলেমদের অক্লান্ত পরিশ্রম জড়িয়ে আছে।

যুগ চাহিদায় আদর্শ মানুষ গড়ার অনন্য প্রতিষ্ঠান

বর্তমান যুগে কওমী মাদরাসা কেবল ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং এটি এক পূর্ণাঙ্গ মানব গঠনের প্রতিষ্ঠান। অতীতে যেমন কওমী মাদরাসা কুরআন-হাদীসের জ্ঞান প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, আজও তেমনি আধুনিক সময়ের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে জাগতিক শিক্ষার দিকেও অগ্রসর হচ্ছে।

এখন কওমী মাদরাসার পাঠ্যসূচিতে শুধু তাফসীর, হাদীস ও ফিকহ নয়; যুক্ত হয়েছে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, কম্পিউটারসহ নানা আধুনিক বিষয়। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন আল্লাহভীরু ও নৈতিক গুণে গুণান্বিত আলেম হিসেবে গড়ে উঠছে, অন্যদিকে আধুনিক বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রেও নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করছে।

এখান থেকে বের হচ্ছে এমন এক প্রজন্ম, যারা একদিকে ইসলামী আদর্শে দৃঢ়, অন্যদিকে দেশের উন্নয়ন ও সমাজকল্যাণে সক্রিয়। তারা হচ্ছে সত্যিকার অর্থে অলরাউন্ডার আলেম — যিনি কিতাবের জ্ঞান রাখেন, একই সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের দিকেও সচেতন।

এই শিক্ষাব্যবস্থা আজ প্রমাণ করেছে, কওমী মাদরাসা কেবল একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং আদর্শ মানুষ, যোগ্য নেতা ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির এক জীবন্ত কারখানা। কওমী শিক্ষার এ নবজাগরণই একদিন জাতিকে নৈতিকভাবে জাগ্রত করবে, আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

উপসংহার

কওমী মাদরাসা শুধু অতীতের গৌরব নয়, এটি ভবিষ্যতের আশাও। যে সমাজে কওমী শিক্ষিত মানুষ থাকবে, সেই সমাজ কখনো মূল্যবোধহীন হতে পারে না। আজ যখন বিশ্ব ভোগবাদ ও নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত, তখন কওমী মাদরাসা আলোর মশাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারণ করি—“হ্যাঁ, কওমী মাদরাসা আমার অহংকার, আমার পরিচয়, আমার শক্তি।”

লেখক: আরবি সাহিত্যিক, শিক্ষক, মাদরাসা দারুর রাশাদ মিরপুর-১২, ঢাকা

এ জাতীয় আরো সংবাদ

মজুতদারের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ

নূর নিউজ

কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে সংবাদ সম্মেলন

নূর নিউজ

জান্নাতিদের কাছে যে মিনতি জানাবে জাহান্নামিরা

নূর নিউজ