হাসান শাওন
শ্রাবণ মাস। কিন্তু গুমোট গরম। হঠাৎ ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি এলো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে ঝিরিঝিরি দেখছেন হয়তো আরামসে। কিন্তু এমন শহুরে বৃষ্টি উদযাপন উত্তরবঙ্গের অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই অবাস্তব। আকাশে কালো মেঘের সঙ্গে সেই জনপদের প্রধান নদী তিস্তা তীরবর্তী মানুষের মনে জাগে শঙ্কা। কেউ কেউ অস্ফুটে বলে ফেলেন – “আবার বুঝি বান আইসলো . . .”
হ্যাঁ, বাংলাদেশের বর্ষাকাল তিস্তাপাড়ে এক নৈমিত্তিক বন্যার সূচনা ঘটায়। ভারতের সিকিম রাজ্যে তিস্তা নদীর জন্ম। বর্ষাকালে ফুলে ফেঁপে উঠে এ নদী ভাসায় দুকূল। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হতেই সংবাদের শিরোনাম হতে থাকে তিস্তায় পানি প্রবাহের উচ্চতা।
পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠে তখন, যখন ভারতীয় প্রান্তে নির্মিত তিস্তার সব বাঁধ খুলে দেওয়া হয়। উজানের পানি তখন প্রবল বেগে ভাটি অর্থাৎ বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে। স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি জোয়ারে ডুবে যায় এ নদীর সব দিক। তিস্তা সেচ প্রকল্প তখন আর কোনো কাজে আসে না। বন্যার প্রকোপে ভাসে উত্তরবঙ্গ। সভ্যতার সব অবদান মুছে দিয়ে এমন বন্যা প্রতিবার প্রমাণ করে প্রকৃতির সামনে কতটা অসহায় মানুষ।
এই তিস্তা বছরের পর বছর মানুষকে ভোগালেও এ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারক রাজনীতিবিদদের যেন এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ, আজকের দিন পর্যন্ত এ দুই দেশের কর্তা বর্গ তিস্তার পানি প্রবাহ নিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য একটি সুষম চুক্তিতে উপনীত হতে পারেনি। এক্ষেত্রে ভারতের অংশে ফায়দা লোটে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় ভোটের রাজনীতি। একইভাবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গেও থেমে থাকে না তিস্তাকেন্দ্রিক ভোটের রাজনীতি। মাঝখান দিয়ে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। তিস্তার কারণে কপাল পোড়ে নদী তীরবর্তী নিম্নবর্গের কোটি মানুষের।
এবার দেশে বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি বা এর ওপর দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১২ জেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কয়েকটি জেলায় ডুবে গেছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও চরাঞ্চল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, লালমনিরহাট, নীলফামারি, রংপুর, কুড়িগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, পাবনা, মানিকগঞ্জ, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ ও ঢাকার নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
পাউবোর পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ মৌসুমে রংপুর, রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও অরুণাচল প্রদেশে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে। এতে তিস্তা নদীর পানি আরও বাড়তে পারে।
প্রতিবারের মতো এবারও বাংলার দুঃখ হয়ে উপচানো পানিতে বন্যার চিত্র ফুটে উঠেছে তিস্তা পাড়ে। কবে এর থেকে পরিত্রাণ সম্ভব? এর উত্তর তাই ভবিষ্যতের পাতায়ই জমা থাকছে। তিস্তাপাড় এজন্য প্রতিবছর দুর্ভাগ্যের প্রতিশব্দ হয়ে উত্তরবাংলাকে প্লাবিত করে।