ভারত-পাকিস্তান: শক্তির প্রদর্শন না ষাঁড়ের লড়াই?

লেখক: ড. আতিয়া আদলান
অনুবাদ: ফয়জুল্লাহ আমান


বিশ্বের সর্বোচ্চ ও গৌরবময় পর্বতমালা হিমালয়ের কোলে বিস্তৃত কাশ্মীর। প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই ভূখণ্ড যেন প্রকৃতির অপূর্ব নিদর্শন। উর্বর সবুজ প্রান্তর, ফলেভরা বাগান, বর্ণিল প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, দিগন্ত বিস্তৃত হ্রদ ও প্রবাহমান জলপ্রপাত — সব মিলিয়ে এটি এক স্বপ্নপুরী।

কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে বিরাজ করছে ভয়াবহ সামরিক উত্তেজনা। এখানে মোতায়েন রয়েছে হাজার হাজার সৈন্য, সুসজ্জিত আধুনিক সমরাস্ত্রে। চারপাশে পারমাণবিক শক্তিধর তিন পরাশক্তি — ভারত, পাকিস্তান ও চীন — যেন কাশ্মীরকে ঘিরে রেখেছে এক অদৃশ্য দুর্গের মতো। বাহ্যিক শান্তির আবরণে ঢাকা এই অঞ্চল যেন অন্তর্দাহে পুড়তে থাকা এক বিস্ফোরক আগ্নেয়গিরি।

আল্লাহ! কী বিস্ময়কর এই ভূখণ্ড! বিশ্বের অন্যতম নয়নাভিরাম ভূমি, অথচ একই সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকৃত অঞ্চলগুলোর একটি।

সংঘাতের মূল: ঐতিহাসিক পটভূমি

কালের ধারায় একসময় এই অঞ্চল শান্তির ছায়ায় ইসলামের পতাকাতলে ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাত ধরে ইসলাম যখন সিন্ধু অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন থেকে মুসলিম শাসনব্যবস্থা এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু ঔপনিবেশিক ইংরেজরা কৌশলে মুসলিম শাসনকে দুর্বল করে দিয়ে হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের প্রভাব বৃদ্ধি করে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করলেও রেখে যায় বিভক্তির বিষফল — কাশ্মীর সংকট।

তারা এই অঞ্চলকে এমন জটিল সীমান্ত ফাঁদে ফেলে রেখে যায়, যা আজও আগুনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলছে। কাশ্মীর ভাগ হয়ে যায় দুই অংশে — পাকিস্তানি কাশ্মীর ও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর (জম্মু ও কাশ্মীর)। উত্তপ্ত এই সীমান্তে বারবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে — বিশেষ করে ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভয়াবহ যুদ্ধ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আবার কি সেই পুরনো যুদ্ধের ইতিহাসই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে?

সাম্প্রতিক উত্তেজনা: কে উসকে দিল আগুন?

“ফিতনা ঘুমন্ত থাকে, আল্লাহ ধ্বংস করুন তাকে, যে এটি জাগিয়ে তোলে”— দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থাকে যেন এ কথাটিই প্রকাশ করে।

উভয় দেশের নেতৃত্ব নিজেদের জনগণের সামনে একে অপরকে চিরশত্রু রূপে উপস্থাপন করে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখার কৌশল নিয়েছে।

গত ২২ এপ্রিল ভারতের কাশ্মীর অংশে এক ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক নিহত হন। ভারত সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানকে দায়ী করে, আর পাকিস্তান তীব্রভাবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যেন এমন এক ঘটনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। দ্রুত যুদ্ধের প্রস্তুতি ঘোষণা করলেন।কিন্তু পাকিস্তানও প্রস্তুত ছিল চমকপ্রদ জবাব নিয়ে।

প্রথম চমক: চীন থেকে উন্নত সমরাস্ত্র সংগ্রহ।

দ্বিতীয় চমক: আধুনিক প্রযুক্তির তুর্কি ড্রোন ‘বাইরাকতার’।

ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কৌশলগত বিভ্রান্তি তখন চরমে। এমনকি ভুলবশত ভারতের নিজস্ব ব্যালিস্টিক মিসাইল ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরেই আঘাত হানে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, যেন ‘দেখে শুনে ব্যবস্থা নেব’— এই নীতিতে চলছে।

তুরস্ক: বন্ধুত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক বিশ্বস্ত মিত্র

এ সময়ে বারবার স্মরণে আসে পশ্চিমা চিন্তাবিদ স্যামুয়েল হান্টিংটনের সেই কথাগুলো:
“একটি ইসলামী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের উচিত অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করা, এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বে এগিয়ে আসা।”

তুরস্ক কি সেই ঐতিহাসিক ভূমিকা ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে? পশ্চিমাদের দরজায় ঘুরে বেড়ানো এক হতাশ আরজদারের ভূমিকা ছেড়ে ইতিহাসের গৌরবময় ভূমিকা কি আবারও গ্রহণ করতে যাচ্ছে?

এর প্রমাণ মিলেছে, যখন তুরস্ক সময় নষ্ট না করে অবিলম্বে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে আধুনিক ড্রোন ‘বাইরাকতার’ সরবরাহ করেছে। এর ফলে পাকিস্তান খুশি, ভারত ক্ষুব্ধ।

প্রশ্ন জাগে— তবে কি সামনে এক নতুন “ইসলামিক ন্যাটো” বা মুসলিম সামরিক জোটের সূচনা হতে চলেছে?

যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত: তাৎক্ষণিক বিজয় না সুদূরপ্রসারী ফাঁদ?

নিঃসন্দেহে যুদ্ধবিরতির এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য এক সহজ ও তাৎক্ষণিক বিজয়, আর ভারতের জন্য এক বড় বিপর্যয়। এটি মুসলিম বিশ্বের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ।

তবে এখানেই যেন সবকিছু শেষ মনে না হয়। সতর্ক থাকা অপরিহার্য। কারণ ভারত— ইহুদিবাদী দখলদারদের (সিয়োনিস্ট) কৌশলগত মিত্র — তাদের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে নিরাপদ থাকার কোনো গ্যারান্টি নেই।

আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ সহায়ক।

লেখক পরিচিতি:ড. আতিয়া আদলান একজন প্রখ্যাত মিশরীয় ইসলামি চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি, মুসলিম উম্মাহর সংকট এবং ইসলামি রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ে তাঁর লেখায় গভীর প্রজ্ঞা ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। আরবি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণাগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে।

অনুবাদক পরিচিতি: ফয়জুল্লাহ আমান দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবাসী ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও অনুবাদক। আরবি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, উম্মাহর সমকালীন সংকট এবং ইসলামি দাওয়াহ বিষয়ক লেখালেখি ও অনুবাদে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

ইসরায়েলি বিমানবন্দরের কাছে বিরাট এলাকা পুড়ে ছাই

আনসারুল হক

আল্লামা বাবুনগরী- মাওলানা মামুনুল হক- সৈয়দ ফয়জুল করীমের বিরুদ্ধে মামলা

আনসারুল হক

‘সভ্যতার স্বার্থেই ইজরাইলের দুর্বৃত্তপনা রোধ করতে হবে’

আনসারুল হক