যা রেখে গেলেন মুফতী আমিনী

জীবন যেভাবে যাপন করবে মৃত্যুও তোমাদের সেভাবেই হবে। যেভাবে মৃত্যুবরণ করবে শেষ বিচারের দিন সে অবস্থায়ই উঠবে। জীবন-মৃত্যুর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন একটা ইশারা রয়েছে।

মুফতী মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ১১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিনভর তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করেছেন। ইবাদত-বন্দেগী, খাওয়া দাওয়া, শিক্ষকতা ও ইমামতিসহ সংগঠন, রাজনীতি, বৈঠক, বিবৃতিদান সবই করেছেন। রাতের মাগরিবের পর থেকে এশা পর্যন্ত লালবাগের ছাত্রদের বোখারী শরীফ পাঠদান করেছেন। একবার বলেছিলেন শরীর খারাপ লাগছে। ১১টার দিকে বেশি খারাপ লাগায় হাসপাতালে যান। সেখানেই রাত সোয়া বারটার দিকে তার ইন্তেকাল হয়। তারিখটা পড়ে যায় ১২ ডিসেম্বর। বহুল আলোচিত ১২-১২-১২ তারিখ মুফতী আমিনী চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

 

তিনি ডায়াবেটিসের রোগী ছিলেন। ক’বছর আগে একবার তার ব্রেইন ষ্ট্রোকও হয়ে গিয়েছিল। মানসিক চাপে তো ছিলেনই। শারীরিকভাবেও দুর্বলতা তার বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে গৃহ বন্দিত্বের ফলে তিনি প্রাণশক্তি অনেকটাই খুইয়ে ফেলেছিলেন। ভাবনা ও তৎপরতায় বাধা পেলে মানুষ যেমন দ্রুত নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তিনিও গত ৪ বছর নানা ধকল সইতে গিয়ে অনেকটা নির্জীব ভাব নিয়ে মনে হয় অকাল মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

জাতীয় ঈদগাহে ১২ তারিখ তার জানাজাপূর্ব সমাবেশে তার পরিবারের লোকজন ছাড়াও একাধিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা বলেছেন, মুফতী আমিনীর মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলা যায় না। তিনি বন্দিদশায় মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অসময়ে চলে গিয়েছেন। সত্যের সংগ্রামে তার নিছক মৃত্যু হয়নি বরং তিনি শহীদী মর্যাদা লাভ করেছেন ইত্যাদি।

তামুতূনা কামা তাহয়ূন ওয়া তুহশারুনা কামা তামুতূন- যদি সত্য হয় তাহলে মুফতী আমিনী সাহেবের মৃত্যু ও জানাজা যেমন ঈর্ষণীয় তার পরকালীন অবস্থাও তেমনি হওয়াই স্বাভাবিক।

মুফতী ফজলুল হক আমিনী একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। কোরআন সুন্নাহ উসুল ফিকাহ ইতিহাস দর্শন ও সাধারণ জ্ঞানের ওপর তার পড়াশোনা, গবেষণা ও চর্চা ছিল অসাধারণ। ছাত্রজীবনে ষ্ট্রিট লাইট বা মসজিদের বাইরের বাতির আলোয় বসে সারারাত বই পড়ার কথা তার সমসাময়িকদের মুখ থেকে শোনা যায়। পরিণত বয়সেও তিনি পাঠাভ্যাস ধরে রেখেছিলেন। কখনো দেখা হলে ইতিহাস ও দর্শন বিষয়ে অধ্যয়ন নিয়ে কিছুটা হলেও মতবিনিময় হত।

শহীদে কারবালা বিষয়ে তার একটি সুলিখিত বই, একাধিক খন্ডে তার ফতওয়া সংকলন, দীনে এলাহী, অসৎ আলেম ও পীর শীর্ষক গ্রন্থে তার নিবন্ধ থেকে তার ভাবনা ও চেতনার ধরন বোঝা যায়।

১৯৪৫ সালের নভেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আমিনপুরে জন্ম নেয়া এ মনীষী মূলত ঢাকার লালবাগ মাদরাসায়ই পড়াশোনা করেন। পরে করাচি মিন্নোরি টাউন থেকে উচ্চতর হাদীস ও ফিকাহ পাঠ সমাপ্ত করেন।

মুফতী মাওলানা ফজলুল হক আমিনী শিক্ষকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন, এক সময় লালবাগ ও বড়কাটারা মাদরাসা পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তই তিনি এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন হযরত হাফেজী হুজুরের জামাতা এবং দুই পুত্র ও চার কন্যার জনক। লালবাগ শাহী মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

মুফতী আমিনী ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অত্যন্ত উদার মহৎ সদালাপি ও অতিথিবৎসল। তার সরল সহজ চলাফেরা ও প্রাণখোলা কথাবার্তা মানুষকে কাছে টানত। তার আচরণে মানুষ খুব দ্রুত তার আপন হয়ে যেত। আল্লাহর সাথে তার গভীর সম্পর্ক এবং আল্লাহওয়ালাদের কর্মপন্থা গ্রহণে অকৃত্রিম সাধনা ছিল তার শক্তি ও সাহসের উৎস। তার ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে মনে হবে যে, তিনি একাই একটি জোট বা বড় দল ছিলেন। কারণ, তিনি এমন কিছু ইস্যু নিয়ে কথা বলতেন, যা হতো বাংলাদেশের দলকানা লোকজন আর গুটিকয় নাস্তিক মুরতাদ ছাড়া দল মত নির্বিশেষে সকল মুসলমানের কমন ইস্যু।

যারা তার দল বা সংগঠন না করলেও ধর্ম, নৈতিকতা বা জাতীয় স্বার্থে আমিনী সাহেবকে সমর্থন করত। অন্যায়, অশ্লীলতা, দুর্নীতি, অপশাসন ও ধর্মবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তার অবস্থানকে পছন্দ করত। তার সত্য উচ্চারণ, নির্ভীক কণ্ঠস্বর ও দুঃসাহসিক অবস্থান বহু মানুষকে উজ্জীবিত করত।

১২ ডিসেম্বর আমিনী সাহেবের জানাজায় লাখো মানুষের ঢল প্রমাণ করেছে যে, তিনি কত জনপ্রিয় ছিলেন। দেশের ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের উপর তার কতটুকু প্রভাব ছিল। আমরা যারা তার সংগঠনে ছিলাম না, তারাও কোন না কোন সুবাদে তার দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম। তার বিরোধীরাও এ প্রভাবের বাইরে ছিলেন না।

জাতীয় ঈদগাহ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে, মৎস্য ভবন, পল্টন, প্রেসক্লাব ও সচিবালয় পর্যন্ত মানুষের ভিড়। নামাজের জন্য যতটুকু ফাঁকা রাখা হয় ততটুকু ফাঁকা না রেখেই দাঁড়িয়েছিল অধিকাংশ কাতার। বেলা দেড়টা থেকে নামাজিরা আসতে থাকেন ঈদগায়। সাড়ে তিনটা পর্যন্ত লোকজন কেবল আসতেই থাকে। ধারণা করা হয়, মুফতী আমিনীর জানাজায় অন্তত পাঁচ লাখ লোক শরিক হন। রাজধানী ও আশপাশের এলাকা শুধু নয় দেশের দূর দূরান্তের জেলাগুলো থেকেও তার সহকর্মী বন্ধু ছাত্র ভক্ত ও সমর্থকরা জানাজায় যোগ দেন।

সাংগঠনিক যোগসূত্র ছিল না অথচ তাকে ভালবাসতেন, এমন মানুষই ছিলেন বেশি। মাওলানা আমিনী চারদলীয় জোট, পরে ১৮ দলীয় জোটের লোক হওয়ায় জানাজাপূর্ব সমাবেশে বিএনপি ও জোট নেতৃবৃন্দ অধিকহারে বক্তব্য রাখেন। চরমোনাইয়ের পীর সাহেব ও ইসলামী এবং সমমনা অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন। চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট থেকে আগত নেতারাও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। ঢাকাসহ সারাদেশের অসংখ্য আলেম উলামা পীর মাশায়েখ উপস্থিত থেকেও কোন বক্তব্য রাখেননি। একেতো সময়াভাব। দ্বিতীয়ত আমিনী সাহেবের রাজনৈতিক প্লাটফরম ১৮ দলীয় জোটের নেতাদের ব্যাপক উপস্থিতি। যা আমিনী সাহেবের বহুবিধ কাজ ও তৎপরতার অন্যতম।

কিন্তু তার মূল এবং পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নয়। মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ঢাকার লালবাগ ও বড়কাটারা মাদরাসার প্রিন্সিপাল। তিনি আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী, পীরজি হুজুর হাফেজী হুজুর ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) এর স্থলাভিষিক্ত ধর্মীয় অভিভাবক। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান। ইসলামী মোর্চা (খেলাফতে ইসলামী) ও উলামা কমিটির আমির।

তার জনপ্রিয়তার কারণ তার সংগ্রামী আলেমসুলভ ভূমিকা। শরীয়তের প্রশ্নে তার আপোষহীন অবস্থান। কোরআনের বিধান পারিবর্তনের বিরুদ্ধে তার জীবনপণ আন্দোলন। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ তসলিমা বিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে ব্যাপকভাবে চিনতে শুরু করে। ফতওয়া বিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে তার বিপ্লবী ভূমিকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয় শহীদের রক্তের বিনিময়ে চার দলীয় জোটের সরকার গঠন মুফতী আমিনীকে রাজনৈতিক অঙ্গনে পাকাপোক্ত আসন করে দেয়।

কিন্তু মুফতী আমিনী শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই ছিলেন দীন ও শরীয়তের জন্য নিবেদিত। ইসলাম ও মুসলিম জনতার স্বার্থ ছিল তার রাজনীতির মূল ভাবনা। বাংলাদেশে ইসলামী শরীয়ার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নই ছিল তার জীবন সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। যারা মুফতী আমিনীকে তার আংশিক পরিচয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, তারা এখানেই মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন।

মাওলানা ফজলুল হক আমিনী কি কেবল একজন সংসদ সদস্য ছিলেন? তিনি কি জোটের একজন নেতা মাত্র? এমপি মন্ত্রী তো এ দেশে নতুন পুরনো মিলিয়ে শত শত আছেন। রাজনৈতিক নেতা আছেন হাজারে হাজার। দেশবাসীর উপর তাদের কারো প্রভাব কি আমিনী সাহেবের মত? ১৮ দলীয় জোটের কোন নেতা এমপি মন্ত্রীটি এমন আছেন যার জানাজায় ২/৪ লাখ আলেম, উলামা, ইমাম, জানাজা জানা এবং ওজু গোসল করা নামাজি লোক সমবেত হবে। পরহেজগার, পাক পবিত্র লোকজন বাদই দিলাম রাজনৈতিক জানাজা আদায়কারী পাঁচ মিশালী
২/৪ লাখ লোকও কি তাদের বিদায় জানাতে আসবে বলে মনে হয়।

নাস্তিক মুরতাদ বামদের কথা আর নাইবা বললাম। জনবিচ্ছিন্ন এসব নেতাদের, দশ পনের জন একদিনে মরলেও শায়খুল হাদীস ও আমিনী সাহেবের সমান বড় জানাজা পাবেন বলে মনে হয় না। ধর্ম, ধর্মপ্রাণ মানুষ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মীয় নেতাদের প্রতি তাদের ক্ষোভের এসবও একটি কারণ। প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার নামে সারা জীবন খোদাদ্রোহিতা ও ধর্মবিদ্বেষচর্চা করে তাদের বড় বড় ব্যক্তিরা যখন মারা যান, তখন প্রশস্ত মাঠে জানাজার জন্য আনাই হয়না তাদের। সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ রাখা হলে দেখা যায় ২/৪’শ বা হাজার মানুষের ‘ঢল’। সপক্ষ মিডিয়ায় ‘জনতার এ ঢলেরই’ প্রচার দেয়া হয় বিশাল আকারে। অপর দিকে ইসলাম সম্পৃক্ত কোন বিষয় বা ব্যক্তি হলে চিহ্নিত মিডিয়া নীরব। বছরব্যাপী ইচ্ছাকৃতভাবে চেপে যাওয়া হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি, অংশগ্রহণ, অনুভব, আকুতি। এ এক নিরন্তর ষড়যন্ত্র। অব্যাহত অন্যায় আর অসততা, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের বোধ-বিবেচনায় এসব অপকর্ম আঁকা হয়ে থাকছে। অন্যায় ও অসততার সাধক ও লালনকারীরা প্রকৃতির নিয়মেই যথাসময় তার ফলাফল দেখতে পারেন। কেন জানি আমার বারবার মনে হচ্ছিল আমিনী সাহেবের জানাজায় প্রধানমন্ত্রী পক্ষ থেকে কোন নেতা, মন্ত্রী অথবা গুরুত্বপূর্ণ এমপি শরিক হবেন।

যেমন শায়খুল হাদীসের জানাজায় তারা এসেছিলেন, বক্তব্যও রেখেছিলেন। কারণ, আমিনী সাহেব ১৮ দলীয় জোটের একার নন। তিনি দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের জনপ্রিয় কণ্ঠস্বর। ধর্মপ্রাণ মানুষ মহাজোটেও আছেন। শরীয়তের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস তাদেরও আছে। কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন সিদ্ধান্ত তারাও পছন্দ করেন না। রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে এমন অনেক ইস্যু আমিনী সাহেবের সংগ্রামী জীবনে এসেছে যার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীনেত্রী এক। সেসব ঈমান আকিদা ও ইসলামী আইন বিষয়ক ইস্যুতে তো রাজনীতি চলে না। প্রভাবশালী, জনপ্রিয় সাহসী, এ নেতার মনোভাব নিয়ে ঠা-ামাথায় কেউ ভেবেছেন বলে তো মনে হয় না। বিষয়টি নির্মোহ দৃষ্টিতে, উদারভাবে দেখলে সরকারের কর্মপন্থা তার প্রতি অন্যরকমও হতে পারত।

প্রায় ২১ মাস তাকে গৃহবন্দীর মত আটকে রেখে, দেশব্যাপী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে সরকার কতটুকু লাভবান হয়েছেন কিংবা এ যাবত কী পরিমাণ মুনাফা তারা ভবিষ্যতে ঘরে তুলতে পারবেন তা প্রশ্ন হয়েই রয়ে যাবে। জানাজায় অংশ না নিয়ে সরকারি পক্ষ আমিনী-প্রভাবিত জনমত থেকে স্পষ্টত বঞ্চিত হয়েছেন। যা মহাজোটের বড় একটি রাজনৈতিক ক্ষতি এবং আপাতত অপূরণীয়।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে, এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠারও বহু আগে ৪ দলীয় জোট ভাঙার যতগুলো প্রয়াস চলে এর প্রতিটিই ব্যর্থ হয় সংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব এবং বিষয় বিশ্লেষণে ব্যাপক অক্ষমতার জন্য। সে সময়টি আমিনী সাহেবকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক কৌশলে, অনেক কষ্টে। এরপর গত ১১ তারিখ তার মৃত্যু পর্যন্তই তিনি ছিলেন বিদ্বেষ, অপপ্রচার, প্রতিহিংসা ও রোষের শিকার। মহাজোট সরকারের বিগত প্রায় চারবছর অহেতুক মুফতী আমিনীকে নানাভাবে টার্গেট করা হয়েছে। যার কোন প্রয়োজনই বর্তমান সরকারের ছিল না। কারণ, আমি শুরু থেকেই বলতে চেষ্টা করেছি যে আমিনী সাহেব বিরোধী জোটের অন্য সকলের মত একজন রাজনীতিকমাত্র ছিলেন না। তার কোন বিশাল সংগঠন ছিল না। তিনি পদ-পদবী, ক্ষমতা ও পার্থিব সম্পদের প্রতি লালায়িত কোন সাধারণ নেতা ছিলেন না। তিনি এ্কটি আদর্শের জন্য জীবনপাত করতেন। তিনি আমৃত্যু ইসলামী আইন বাস্তবায়নের স্বপ্নলালন করতেন। তিনি শরীয়ত ও সুন্নাহ প্রয়োগের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তার রাজনীতি, তার জোটবদ্ধতা তার প্রজ্ঞা কৌশল সবই নিবেদিত ইসলাম ও মুসলমানের জন্য।

আল্লাহ ও রাসূলের (সাঃ) মনোনীত জীবনব্যবস্থার জন্য। তিনি তার মূল উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য উপযোগী রাজনীতি বেছে নিয়েছেন। তার আলোচনার দুয়ার সবসময়ই খোলা ছিল সব রাজনীতিকের জন্য। কিন্তু মুফতী আমিনীর ভাবধারা ধরতে না পেরে স্থূলচিন্তার নেতারা সবসময়ই কেবল ভুল করে গেছেন। অথচ মুফতী আমিনীর মত একজন উচ্চশিক্ষিত প্রজ্ঞাবান ও মেধাবী নেতাকে খুব স্বার্থকভাবে নিজের জনপ্রিয়তার সপক্ষে কাজে লাগাতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী। তাকে বিরোধী অবস্থানে রেখেই এবং সম্মানিত বিরোধী ব্যক্তিরূপেই। কেবল প্রয়োজন ছিল আমিনীর প্রভাব, চিন্তা, অনুসারী ও সমর্থকদের বিষয়ে গভীরভাবে জানা এবং ইতিবাচক ব্যবহারের।

বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম জিয়া দীর্ঘসময় কাছে পেয়েও মুফতী আমিনীকে কাজে লাগাতে পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন। এমন না হলে হয়ত তার রাজনীতি আজ এমন দুরবস্থায় এসে পৌঁছুত না। মৃত্যুর পর তিনি আমিনীর কবর জিয়ারত করছেন। তার বাসভবনে হাজির হয়ে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করছেন। কিন্তু জীবদ্দশায় আমিনীকে কোন পদ, সম্মান কিংবা সহায়তা দেননি।

দেশের বড় দুই নেত্রীই মুফতী আমিনীর দ্বারা উপকৃত ও সমৃদ্ধ হতে পারতেন। কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমিনী সাহেবের যে ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছিল সেই হাফেজ মাওলানা আবুল হাসানাতকেই পিতার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। মুফতী আমিনীর আরদ্ধ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার আন্দোলনের নেতাকর্মী ও তার ভক্ত অনুসারীরা আবুল হাসানাতকেই বেছে নিয়েছেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে মুফতী সাহেবের হাতেগড়া নেতৃত্ব যদি ধৈর্য, গঠনমূলক কৌশল ও সাধনার পথ ধরে এগিয়ে যায়, তাহলে আদর্শের সংগ্রাম শতগুণ ব্যাপ্তি ও শক্তি অর্জন করবে।

ইসলামী আইন বাস্তবায়নের স্বপ্ন যেমন অমর, এর তৃণস্পর্শী আন্দোলনও হবে চির অক্ষয়। দল, সংগঠন, জনশক্তি, বাহ্যিক শক্তি প্রদর্শন, অর্থবিত্ত ইত্যাদি কিছু দিয়েই যার গভীরতা মাপা যায় না। দেহে লুক্কায়িত প্রাণশক্তির মতই অদৃশ্য এ শক্তিমত্তা বাংলাদেশের সমাজ জীবনে, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে যুগ যুগ ধরে তার ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিস্তার করে যাবে।

মুফতী ফজলুল হক আমিনীর সাথে যারা নানা বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, যারা লক্ষ্য উদ্দেশ্য এক হওয়া সত্ত্বেও তার কর্মপন্থার সাথে একমত ছিলেন না, তারা সবাই যেমন আজ তাকে হারিয়ে খুঁজছেন, তার একান্ত ভক্ত- অনুসারীরাও আজ তাদের নেতাকে হারিয়ে শোকাহত। আমার মনে হয় তার পক্ষ ও বিপক্ষের সকলেই একটি বিষয়ে একমত হবেন যে, একটি ব্যক্তি কী পরিমাণ সাহসী, স্পষ্টভাষী ও প্রভাবশালী হলে তসবিহ উঁচিয়ে বলতে পারেন এটাই আমার অস্ত্র। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। মন্ত্রীরা ঐকতানে তার দুর্নাম ছড়ান। বাম নেতারা লাখো মানুষ সাথে নিয়ে তাকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। নির্যাতিত লোকটি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে খতম দোয়া আর তিলাওয়াত করে বলে, আমার একটি পুত্র কেন, যদি গোটা পরিবারকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়, তথাপি আমি ইসলামের স্বার্থ ঊর্ধ্বেই তুলে ধরে রাখবো। সব ধরনের বাধা, মামলা, হামলা, ভয়ভীতির ভেতর থেকেও তিনি কাছে পাওয়া লোকজনকে নিজের মিশনের কথা, অ¯িস্থরতার কথা, আবেগ-উৎকণ্ঠার কথা, অনিশেষ সংগ্রাম ও সাধনার কথা বলে গিয়েছেন।

বোখারীর সবক দিয়েছেন। নামাজে ইমামতি করেছেন। নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলেছেন। আগামী দিনের করণীয় নির্ধারণ করেছেন। সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছেন। লাখো মানুষকে নাড়া দিয়ে না ফেরার পথে পা বাড়িয়েছেন। কোটি মানুষের মনে দাগ কেটে গেছেন। বলে গেছেন যে কোন মূল্যে ইসলামকে ধারণ করে রেখো। দল, মত, জোট, মহাজোট নির্বিশেষে সকল মুসলমান। যুগে যুগে মুফতী আমিনীরা এ বার্তাটিই রেখে যান।

এ জাতীয় আরো সংবাদ

জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে হেফাজতের কোন সমর্থন নেই: আল্লামা সাজিদুর রহমান

নূর নিউজ

স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নবীন আলেমদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে, আল্লামা রাব্বানী

নূর নিউজ

মুফতি ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, কাল তোলা হবে আদালতে

নূর নিউজ