ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) বলেছেন, গত বছর জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে অনেক শিক্ষার্থী জীবন দিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে এবং চোখ হারিয়েছে একটি সুন্দর দেশ পাবার জন্য। প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি কালো টাকার দৌরাত্ম্য, পেশিশক্তি এবং ভোট জালিয়াতির সুযোগ করে দেয়, যা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার এবং চাঁদাবাজির জন্ম দেয়। তাই এই নির্বাচন পদ্ধতি আর বাংলার জমিনে দেখতে চাই না। পিআর পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতি চালু হলে একটি সুষম সংসদ তৈরি হবে। বিশ্বের ৯১টি দেশে এই পদ্ধতি চালু আছে এবং কোনো দেশই এটিকে বাতিল করেনি। বরং নতুন নতুন দেশ এই পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে।
আজ শুক্রবার ২২ আগস্ট ২০২৫ দুপুর ২টায় রাজধানীর শাহবাগে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রসংস্কার, সংখ্যানুপাতিক (PR) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ইনসাফভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আয়োজিত ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছাত্র সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি ইউসুফ আহমদ মানসুর এবং সঞ্চালনা করেন সেক্রেটারি জেনারেল শেখ মাহবুবুর রহমান নাহিয়ান।
তিনি বলেন, দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দলই পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চায়, কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এর বিরোধিতা করছে। তাই সরকারের প্রতি গণভোটের আহ্বান জানাচ্ছি, জনগণের কাছে মত জানতে চাওয়া হোক-তারা কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) পরিচালিত এক জরিপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেখা গেছে, ৭১ শতাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি কয়েকটি মৌলিক দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের দৃশ্যমান বিচার করতে হবে। সব শেষে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর দায়িত্বশীলদের প্রতি আদর্শবান হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, তোমরা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর আচরণ থেকে শিক্ষা নাও, যারা সন্ত্রাসী, খুনি ও চাঁদাবাজির মতো অপকর্মে জড়িত। তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তোমরা এমন একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করো যা ইসলাম চায়। ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ছেলেরা ৩৪ বছরে কোনো বদনাম অর্জন করেনি, যা আল্লাহর বিশেষ রহমত। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে এবং দেশ থেকে খুনিদের উৎখাত করা সম্ভব হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম (শায়খে চরমোনাই) বলেন, তারেক রহমান আর জয়ের মৌলবাদবিষয়ক বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মৌলবাদ নিয়ে যারা আজ সমালোচনা করেন, তারাই একসময় ডানপন্থীদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে ইসলাম বিজয়ী হবেই-এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। যারা মৌলবাদকে ভয় দেখায় তারা মূলত ইসলাম বিদ্বেষী। পিআর বাংলাদের মানুষের প্রানের দাবি।
মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, গত জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে যারা আহত ও শহীদ হয়েছেন, তাদের আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ, ইনসাফভিত্তিক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন করছে। এ সংগঠনের মধ্যে কোনো সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত বা দুর্নীতিবাজ নেই। তারা নৈতিকতার পতাকাবাহী। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে এগিয়ে যাও তোমরাই বিজয়ী হবে।
কেন্দ্রীয় সভাপতি ইউসুফ আহমাদ মানসুর বলেন, ২৪-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ কোনো স্বৈরাচার, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা বা সন্ত্রাসীদের হাতে বন্দি হতে পারবে না। জনগণের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার এবং শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সময়ের অপরিহার্য দাবি। তরুণ প্রজন্মের প্রতিটি ভোট যেনো মূল্যায়িত হয়, ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি রোধ হয়, সেজন্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতি ও সন্ত্রাস বন্ধ করে সুস্থ রাজনীতির চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ ডাকসু, জাকসু, রাকসুর নির্বাচন যথাসময়ে আয়োজন করতে হবে, যাতে ক্যাম্পাস থেকে সৎ, যোগ্য ও আদর্শ নেতৃত্ব উঠে আসে।
এসময় সমাবেশে ৭দফা দাবী সংবলিত প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মুনতাছির আহমাদ।
১. ২৪ পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে যেনো কোন নির্বাচিত স্বৈরাচার, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও সন্ত্রাসী শ্রেনী রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করতে না পারে এবং একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক রাষ্ট্রসংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে এবং ছাত্রজনতার প্রত্যাশার প্রতিফলন স্বরুপ শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আগামী জাতীয় নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের প্রতিটি ভোটের মূল্যায়ন, ফ্যাসিজমের পূণরাবৃত্তি রোধ এবং জাতীয় সরকার গঠনে সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে।
৩. জুলাই ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে বৈষম্যহীন শোষন নিপীড়ন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মানে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের আইনিভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৪. ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন এবং ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বৈষম্য মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৫. ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে অপরাজনীতি এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধ, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সহাবস্থান তৈরি, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত এবং জাতীয় পর্যায়ে সৎ, যোগ্য ও আদর্শ নেতৃত্ব তৈরিতে সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। একইসাথে ঘোষিত ডাকসু, জাকসু ও রাকসুতে তফসিল অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
৬. পতিত ফ্যাসিবাদ এবং পিলখানা, শাপলা ও জুলাই সহ সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এবং বিদেশে পালাতক অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।
৭. দেশে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও খুনখারাবি রোধে প্রশাসনকে কার্যকর দায়িত্ব পালন করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ মাদানী, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, সহকারী মহাসচিব আহমাদ আবদুল কাইয়ুম ,সৈয়দ ইসহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের, কে এম আতিকুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ্ ইফতেকার তারিক, দাওয়াহ ও দফতর সম্পাদক লোকমান হোসাইন জাফরী, নূরুল করীম আকরাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, মাওলানা মুহাম্মদ নেছার উদ্দিন, এবিএম জাকারিয়া, ইসলামী যুব আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আতিকুর রহমান মুজাহিদ, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফি, অ্যাডভোকেট শেখ আবু নাসের, ইসলামী শ্রমিক আন্দোলনের সিনিয়র সহ-সভাপতি হাফেজ মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান।
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল মিশকাতুল ইসলাম, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ইমরান হোসাইন নূর ও খায়রুল আহসান মারজান, সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ, প্রশিক্ষণ সম্পাদক হোসাইন ইবনে সরোয়ার, তথ্য গবেষণা ও প্রযুক্তি সম্পাদক মুহাম্মাদ ফয়জুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় দাওয়াহ ও দফতর সম্পাদক ইবরাহীম খলিলসহ আরও অনেক কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।